প্রকৃতিতে কোন ধর্মের বিভাজন নেই | সানজিদা হোসাইন ।
প্রকৃতি চলে তার নিজস্ব গতিতে। ঋতুচক্রও আবর্তিত হয় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। প্রকৃতিতে কোন ধর্মের বিভাজন নেই। সূর্য কখনো বলে না “আমি অন্য ধর্মের কাউকে আলো দেবো না।” গাছ অক্সিজেন দেওয়ার সময় ভাবেনা তাঁর তলায় যে বসে আছে সে কোন ধর্মের। যারা রমযান মাসের পবিত্রতা রক্ষায় ইবাদতে মনোনিবেশ করে আছেন, তাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলতে চাই, নববর্ষ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান না। বাঙালী জাতির সব ধর্মাবলম্বী মানুষদের প্রাণের উৎসব নববর্ষ।
গত দুই বছর যে নববর্ষের ভোরে বটতলায় “এসো হে বৈশাখ” গান গেয়ে বৈশাখকে আসতে বলা হয়নি, তাই বলে কি বৈশাখ আসেনি?
করোনার প্রকোপে দুই বছর চারুকলায় মঙ্গলশোভাযাত্রা হলো না, তাতে আর আলাদা করে কী অমঙ্গল হয়েছে?
তেমনি আজ যদি কেউ সেহরি বা ইফতারিতে পান্তা ইলিশ নাও খায়, তাতেও অসচেতন বাঙালী হিসেবে তার নাম্বার কাটা যাবে না।
তবে বাংলাদেশ যদি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবার হয়, বাংলা ভাষা যদি সবার হয়, তবে বাংলা ক্যালেন্ডার এর নতুন বছরকে বরন করে নেয়ার যে অনুষ্ঠানের নাম নববর্ষ, সেটাও সবার…সব বাঙালির।
বিশ্বে প্রথম নববর্ষ উদযাপন করে ব্যাবিলনীয়রা, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে। এরপর সুমেরীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতার নববর্ষের কথাও জানা যায়। বিশ্বের প্রায় সকল জাতির গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ছাড়াও তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার আছে। সকল জাতি তার নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে বছরের প্রথম দিনটিকে বরন করে নেওয়ার জন্য তাদের সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে আয়োজন সাজায়। বাঙালিরও একটা নিজস্ব বর্ষপঞ্জি আছে। অন্য সব ক্যালেন্ডারের মতো আমাদের বর্ষপঞ্জির পাতা ফুরিয়েও একটা নতুন বছর আসে ষড়ঋতুর ডালি সাজিয়ে। আর তাই বাঙালি হিসেবে আমার অধিকার আছে নববর্ষের চিরায়ত সাজে নিজেকে সাজিয়ে তোলার।
বাংলা সনের স্রষ্টা মুঘল ভারতের শ্রেষ্ঠ গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ খান সিরাজী। আর যাঁর নির্দেশে এই সনের জন্ম তিনি হলেন সম্রাট জালালউদ্দীন মোহাম্মদ আকবর। পরবর্তী সংস্কারক সম্রাট শাহজাহান ও ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা সন প্রবর্তিত হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। বাংলা সনের প্রথম নাম ছিল তারিখ-ই-ইলাহী। বঙ্গাব্দ নামকরণ হয় ১৫৮৪ সালের ১১ মার্চ। বাংলা সনের গণনা শুরু ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর, ২য় পানিপথ যুদ্ধে হিমুর বিরুদ্ধে আকবরের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য।
প্রকৃতিতে কোন ধর্মের বিভাজন নেই | সানজিদা হোসাইন ।
মুঘল শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো হিজরী সন অনুসারে। আর ফসল তোলা ও খাজনা আদায় হতো সৌরসন অনুযায়ী। এতে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা দূর করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করে জন্ম দেন বাংলা সনের। হিজরী সনকে মডেল হিসাবে নিয়ে তিনি এর কাজ শুরু করেন। সেই হিসাবকে সামনে রেখে ৯৬৩ হিজরীর মুহররম মাস থেকে বাংলা বর্ষের ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত করা হয়। হিজরী মুহররম মাসের সাথে বৈশাখের মিল থাকায় ভারতের প্রচলিত শকাব্দের চৈত্র মাসকে বাতিল করে বৈশাখকে করা হয় বঙ্গাব্দের প্রথম মাস। ৪৪৫ বছর পর হিজরীর সাথে বঙ্গাব্দের পার্থক্য দাঁড়ায় ১৪ বছর। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে পার্থক্য ছিল ৫৯৩ বছর। অর্থাৎ বাংলা সনের সাথে ৫৯৩ যোগ করলেই পাওয়া যাবে খ্রিস্টাব্দ।
বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের শুরুর দিকে বাংলা মাসের ৩০ দিনের ৩০টা নাম ছিল। নামগুলো মনে রাখাও ছিল কষ্টসাধ্য। তাই বাংলা সনের প্রথম সংস্কারক সম্রাট শাহজাহান এক পর্তুগিজের সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা সাপেক্ষে প্রতিটি মাসকে ৪ টি ভাগে ভাগ করে সূচনা করেন সপ্তাহের। প্রতিটি সপ্তাহ ৭ দিন। গ্রেগরিয়ান পদ্ধতিতে দিনের নাম ঠিক করা হয়, sun থেকে রবি, moon থেকে সোম ইত্যাদি। সূচনার সময় বাংলা মাসগুলোর নাম ছিল খোরদাদ, মেহের, শাহরিয়ার, ইসফান্দ ইত্যাদি।
পরে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের নাম অনুসারে নাম রাখা হয়।
সারাবিশ্ব যেহেতু খ্রিস্টাব্দের হিসেবে চলে তাই বাংলা সনকে তার সাথে সঙ্গত রাখা দরকার।বিশেষ করে লিপইয়ারের ঝামেলা দূর করা এবং বাংলা সনকে যুগোপযোগী করার ভাবনা থেকেই ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি ।
বাংলা সনের বর্তমান রূপটি এই কমিটিরই অবদান।
পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনা করেছিলেন সম্রাট আকবর। তিনিই এই উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। আকবরের সময় কাল বা বঙ্গাব্দের আগেও কিন্তু নববর্ষ পালিত হতো। সেটা ছিল বাঙালির প্রাচীন এক কৃষি উৎসব। ঋতু ভিত্তিক ছিল বলে সেটাকে আর্তব উৎসবও বলা হতো। সেই যুগে সূর্যের গতিবিধির ওপর নির্ভর করে ফসল বোনার কাজ করা হতো। তাই তাদের কাছে সেটা ছিল সৌর সন।
ভারতবর্ষের সব কৃষিজীবী নৃগোষ্ঠীই এই সৌর সনকে মেনে জীবিকা নির্বাহ করতো। বঙ্গাব্দের তারিখ অনুসরণ করলেও সেই সৌরসনের নববর্ষ ঘুরে ফিরে ১৪ বা ১৫ এপ্রিল এর দিকেই উদযাপিত হয়।
তখন সবাই বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটাই একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটা হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা হচ্ছে একটা নতুন হিসাব বই। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিন দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করেন। এই প্রথাটা এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে।
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে নববর্ষ উদযাপনের পক্ষে বা বিপক্ষে কেউই সেটার প্রবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত না হয়েই নিজেদের মতো করে মতামত উপস্থাপন করেন। এমনকি জাতীয় পর্যায়ে নববর্ষ উদযাপন করেন যারা সেখানেও কোথাও আকবর, সিরাজী, শাহজাহান ও শহীদুল্লাহকে স্মরণ করা হয় না।
যে জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে, ধর্মবৈষম্যের বেড়াজালে আটকে আমরা সেটাকে ধ্বংস করে ফেলতে পারি না। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনা হিসেবে পালিত একটা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটা ছিল না। পহেলা বৈশাখ মূলত আমাদের পূর্ব পুরুষদের ফসলি উৎসব। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান… যারাই কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিলেন সবার উৎসব। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।
প্রকৃতিতে কোন ধর্মের বিভাজন নেই | সানজিদা হোসাইন ।
মুসলিম ধর্ম সমর্থন করে না এমন অনেক আচার অনুষ্ঠান, রীতি নীতি আমরা অনায়াসেই প্রতিনিয়ত পালন করে যাচ্ছি। সেগুলো নিয়ে যাদের কোন সমস্যা নেই, তারা আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় প্রাণের উৎসব নিয়েও কোন আপত্তি করবেন না আশা করি। শালীনতা বজায় রেখে প্রতিটি দিনকে উৎসব মুখর করে বেঁচে থাকার আনন্দটা উপভোগ করা যায়।
উৎসব হোক, বা ধর্ম.. কোনোটা নিয়েই বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। বাংলাদেশে জন্মে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলা বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে উদযাপন করা দোষের কিছু না। তবে যে কোনো উৎসবেই শিষ্টাচার বজায় রাখা একান্ত জরুরী। শুধু সাজ পোশাক আর রীতি রেওয়াজ নিয়ে আপত্তি তোলায় আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। জীবনবোধে যদি ধর্মীয় সংস্কারগুলোর মূল্যায়ন করা না যায়, তবে বাংলাকে হিন্দুর তকমা লাগিয়ে নিজেদের একটা প্রাণহীন উৎসব বিমুখ জাতিতে পরিনত করে বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ করে তোলা কেবল। ধর্মীয় মূল্যবোধ বজায় রেখে জীবনের যে কোনো মুহূর্তকে উদযাপন করা যায়। কাঞ্চিপুরাম শাড়ি যদি শুধু হিন্দুদের না হয়, স্যুট ব্লেজার যদি খৃষ্টানদের লেবাস না হয়, তবে নববর্ষও হিন্দুদের না। নববর্ষ বাঙালির।
আমাদের বাংলা সালটা শ্রাবণের মেঘে ঢাকা চাঁদের মত, কিছু কিছু মুহূর্তে উঁকি দিয়ে আবার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আজ যেমন উঁকি দিচ্ছে। আবার দেবে পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, পহেলা ফাল্গুন। এরকম আরো কয়েকটা দিন। যদিও এখনও গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো এই দিনপঞ্জিকা মেনেই চলে। যেমন আমার কাজের মেয়েটা যখন বলে আশ্বিন মাসে বাড়ি যাবে, আমি দিশাহীন হয়ে মনে মনে হিসাব করি সেটা ইংরাজি মাসের কোন সময় হবে। যে বাংলার কত গান… কথা… কবিতা বুকে নিয়ে থাকি, যে বাংলা নিয়ে এতো গর্ব, এমন একটা সংস্কৃতির ধারা রক্তে আছে বলে এতো অহংকার, সেই বাংলা বছরের প্রথম দিনটাকে ধর্মের গন্ডীতে আবদ্ধ করে জীবনের রঙটা ফিকে না করে ফেলি।
আমার দাদা জীবিত থাকতে বলেছেন, নববর্ষে তাদের প্রার্থনা ছিল.. ভালো ধান হোক, নদীতে পুকুরে আরো মাছ হোক, আরো জবা, শালুক, পদ্ম, টগর, নয়নতারা ফুটুক, আরো আম জাম কাঁঠাল হোক, ফসলফলা বৃষ্টি হোক, শিশিরভেজা সকালগুলো দূষণমুক্ত হোক, চারিদিক সবুজ হোক, দেশে শান্তি আসুক, সবার ভালো হোক। এসব প্রার্থনায় কোথাও কী কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত করা আছে? সেই সহজ সরল নির্মল মনের মানুষগুলোর সাথে আমাদের পার্থক্য হলো,
আমরা ধর্মকে ভালো বলি.. আর তারা ভালোত্বকে ধর্ম।
সারা দেশ যখন আনন্দে ভেসে নতুন বছরকে বরন করে নেয়, তখন যারা ঘরে কপাট দিয়ে সূর্যালোককে প্রত্যাখ্যান করে, তাদেরসহ সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন বছর সবার জীবনে আনন্দ বয়ে আনুক। একটা সুন্দর, সুস্থ আগামীর প্রত্যাশায় বাংলা বছরের প্রথম দিনে সব ধর্মের মানুষের আজ একটাই প্রার্থনা হোক…
“মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা…”
বাংলা নববর্ষ আমাদের সকলের জন্য বয়ে নিয়ে আসুক সুখ, সমৃদ্ধি। ধর্মের নামে সকল বিভেদ দূর হয়ে যাক। আমরা সবাই বাঙালি… এই পরিচয়েই এক ও অভিন্ন হয়ে নতুন বছরের একটা শুভ সূচনা হোক।
স্বাগতম হে ১৪২৯, সবাইকে শুভ নববর্ষ।
প্রকৃতিতে কোন ধর্মের বিভাজন নেই | সানজিদা হোসাইন ।