সেই দোপাটিকে দেখেছি বড়োবেলায় এসে। যখন নিজের বারান্দা বাগানের জন্য দোপাটির চারা কিনলাম।
গানটার কথা তখনই মনে পড়ল। ভাবলাম, দোপাটি ফুল দেখতেই এতো সুন্দর প্রিয়’র মান না ভেঙে কোথায় যাবে? আজ সেই সুন্দরী দোপাটির ইতিবৃত্ত জানব আমরা।
গ্রাম-বাংলার পরিচিত ফুল দোপাটি, যার বৈজ্ঞানিক নাম: Impatiens balsamina। ইংরেজিতে বলা হয় Garden Balsam, Lady Slipper, Garden Balsam, Rose Balsam, Touch-me-not বা Spotted Snapweed ইত্যাদি। এটি Balsaminaceae পরিবারের ইম্পেসেন্স গোত্রের একটি সপুষ্পক বর্ষজীবী বিরুৎ উদ্ভিদ।
দোপাটি দেখতে কেমন? রঙ কী তার?
impatients balsamina flower
দোপাটি সুন্দরীর ইতিবৃত্ত | সালসাবিলা নকি
দোপাটি ফুলের পাপড়ি সাধারণত বাইরের দিকে খোলা থাকে। এর পাপড়ি খুব নরম ও কোমল। সাদা, গোলাপি, বেগুণী, লাল, কমলা এবং মিশ্র রং এর দেখতে পাওয়া যায়। এর কান্ড খুব নরম, রসপূর্ণ ও ভঙ্গুর হয়।
শুরুতে এর কান্ড রোমবিহীন মসৃণ হলেও পরে অবশ্য রোমশ হয়। পাতা ছোট ছোট, লম্বাটে। পাতার কিনারায় হালকা কাঁটা যুক্ত খাঁজ থাকে। দোপাটি গাছ বেশ ঝোঁপালো হয়। এর ফুল সিঙ্গেল ও ডাবল হয়। বৃন্ত সরু হয়। দৈঘ্যে ১-২ সেন্টিমিটার হয়। এর বীজ বাইরের দিকে আলাদা ভাবে থাকে। পুংকেশর ৫টি, পুংদন্ড খাটো, পরাগধানী সংযুক্ত থাকে। গাছের উচ্চতায় দেড় থেকে দুই ফুট পর্যন্ত হয়।
দোপাটি বর্ষাকালীন ফুল। তবে সারা বছর এই ফুল ফোঁটে। বর্ষায় অবশ্য এর ফলন সবচেয়ে বেশী হয়।
এটি একটি সুগন্ধীহীন ফুল।
দোপাটি ফুলের গুরুত্বঃ বাণিজ্যিকভানে দোপাটি ফুলের খুব একটা গুরুত্ব নেই। তবে সৌন্দর্য্য প্রিয় মানুষেরা এই ফুল ব্যবহার করেন। সারা বছর বিভিন্ন পূজোয় এই ফুল ব্যবহৃত হয়। বাগান বা ছাদের টবে বা পার্কে সাজাতে ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে এই ফুল ব্যবহৃত হয়।
দোপাটি ফুলের বিস্তারঃ এই ফুলের আদি নিবাস ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও চিনসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃর্ণ অংশ জুড়ে। এটি সাধারণত পৃথিবীর উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পাওয়া যায়।
দোপাটি ফুলের বিভিন্ন প্রজাতিঃ দোপাটি ফুলে বেশ কয়েটি প্রজাতি দেখে পাওয়া যায়। তার মধ্যে সেরা দুটি হল ক্যামেলিয়া এবং বালসাম ।
impatients balsamina flower
দোপাটি সুন্দরীর ইতিবৃত্ত | সালসাবিলা নকি
টবে দোপাটি ফুলের চাষের জন্য যা করতে হবেঃ
দোপাটি ফুল প্রধানত একপ্রকার পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে। বীজ থেকে এদের বংশবিস্তার হয়।
দোপাটি ফুল গাছের চাষের জন্য ভেজা মাটি তবে খুব বেশী স্যাঁতসেঁতে আর্দ্র মাটি প্রয়োজন হয় না। আবার মাটি যাতে বেশী ভিজে কাঁদা কাঁদা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর কোনো কারণে মাটি বেশী স্যাঁতস্যাঁতে বা ভিজে থাকলে সেই কয়দিন পানি না দিলেই ভালো। সরাসরি রোদ সইতে পারে।
দোপাটি ফুল গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত তিনটি ঋতুতেই দেখা যায়। শীতের শেষে এই গাছ টবে পুঁতলে ভালো হয়। অথবা বীজ নিয়ে মাটিতে পুতলে নতুন চারাগাছ জন্মায়। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় ফুল হয় খুব বেশি।
কেমন মাটি দোপাটির জন্য উপযুক্তঃ
উর্বর দোঁআশ মাটি ও বেলে মাটি দোপাটি ফুল চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। এঁটেল মাটিতে এই ফুল ভালো হয় না। যদি টবে দোপাটি চাষ করতে চান তাহলে প্রথমেই যা করতে হবে, পরিমাণমতো দো-আঁশ বা বেলে মাটি এর সাথে গোবর, পাতাসার মিশিয়ে সারমাটি তৈরী করা। এর মধ্যে বীজ বপন করতে হবে। এছাড়া চারাগাছও বপন করা যায়। মাটি সবসময় ঝুরঝুরে থাকতে হবে। এরপর বীজ বা চারাগাছ বপনের কয়েকদিন পর থেকে নির্দিষ্ট পরিমান পানি নিয়ে তাতে কিছুটা ভি.এ.পি, কিছুটা ম্যাগেশিয়াম সালফেট, কিছুটা মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। তাতে ফুলের বৃদ্ধি হবে তাড়াতাড়ি। এতে টবের মাটি ভাল থাকবে। এটা অবশ্যই গাছ কিছুটা বাড়লে দিতে হবে। গোবর সার, চাপান সার ও রাসায়নিক সার এই গাছের জন্য ভাল। এছাড়া ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি সারও দিতে পারেন।
যেভাবে পরিচর্যা করতে হবেঃ
খুবই লক্ষ্মীমন্ত একটা গাছ এই দোপাটি। খুব বেশি যত্নের প্রয়োজন পড়ে না। সার হিসেবে চাপান সার বা তরল সার দেয়া যায়। অথবা ব্যবহৃত চাপাতা শুকিয়ে, ডিমের খোসা একসাথে গুড়ো করে দেয়া যায়। দোপাটি গাছে পানি দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে গোড়ায় অত্যাধিক পানি জমে না থাকে। নিয়ম করে কিছুদিন পরপর মাটি খুঁচিয়ে দিতে হবে।
দোপাটি সুন্দরীর ইতিবৃত্ত | সালসাবিলা নকি
এই গাছে গুঁড়ো চিতি রোগ হতে পারে। তাতে পাতা ও ডাঁটায় সাদা ও ছাই রঙের পাতলা আস্তরণ পড়ে। আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। গাছ পচে মরে যায়। এক্ষেত্রে দ্রবণীয় গন্ধক পানি গুলে পাতায় ২-৩বার ছড়াতে হবে।
ভেষজ গুনাগুনঃ
দোপাটি ফুল গাছের পাতা ও মূলের রস ত্বকের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিকারক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পাতার রস সাপের কামড়নো স্থানে দিলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। ফুলের রস শরীরের পোড়া অংশে দিলে জ্বালাপোড়া কিছুটা কমে। পাতা ও মূলের রস ক্ষত বা নখের ফাটল রোধে কাজ করে। এছাড়াও দোপাটি ফুল বলবর্ধক ও পোড়া ঘা নিরাময়ে কাজ করে।
অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ও ভেষজ গুণাগুণে সমৃদ্ধ এই ফুলগাছ চাষ করা যেহেতু খুব সহজ আর খুব একটা পরিচর্যার দরকার পড়ে না তাই আশা করা যায় বাড়ির ছাদে, ঘরের বারান্দায় কিংবা বাড়ির আঙিনায় দোপাটি ফুলের বেশি বেশি দেখা মিলবে।