ফ্লাইট টার্মিনাল দুইয়ে এসে থেমেছে । আহসান সাহেবের চোখের ঘুমটা এখনো কাটেনি । গায়ে এখনো ম্যাজম্যাজ ভাব । প্লেন থেকে নেমে লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন ডিপার্চারের।এই দেশে বলা চলে এইই প্রথম আসা।ঠাটবাটে বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড উন্নত একটা দেশ। চারিদিকে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ।ঝকমক করছে সব কিছু৷ ছাদগুলোয় আলোকসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে বড় বড় হীরের মধ্যে ফ্লুরোসেন্ট লাইট ফিট করা। সেই আলোয় সবার মুখ ঝকমক করছে৷
এখানকার হর্তাকর্তা থেকে শুরু করে সিকিউরিটি গার্ডগুলো যেন কোন দেশের রাজপুত্র৷ যেমন চেহারা তেমনি কাপড়চোপড়।মেইনটেনেন্স দেখে বলতেই হবে এই দেশের সরকারের উপচে পড়া টাকা । এয়ারপোর্টের মেঝেতেও টাকা ঢেলেছে। মেঝেগুলো যেন কালো গ্রানাইটের আয়না। এয়ারপোর্টের পিলার গুলো ঘনসবুজ মার্বেল পাথরের, তার মাঝে থেকে থেকে মেটালের নক্সা করা! মেটালগুলো সোনার বলে বিভ্রম হয়৷ মেঝের সাথে ফিট করা চেয়ারগুলো সাদা স্ফটিকের অথচ বসতে কী দারুণ আরাম; সুপ্রিম কোয়ালিটির ইন্টেরিয়ার।
আহসান সাহেব নিজে বড় বিল্ডার, তবুও মানতেই হবে এখানকার ফিটিংসগুলো একেবারে টপনচ! তবে পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দিলেন।এখানকার ফিটিংস টপনচ হবে না তো কার হবে? ছোটলোকের যত ছোট চিন্তা। আহসান সাহেব ভিড়ের দিকে মনোযোগ দিলেন।
তিনি যে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন সেটার নাম প্যারাডাইস লাউঞ্জ। তার সাথের সহযাত্রী সবার মুখে কেমন অদ্ভুত প্রশান্তি।সফরে সবাই আহসান সাহেবের মতো ঘুমিয়ে নিয়েছেন নাকি?
বিশাল এয়ারপোর্টের এক কোণা থেকে আরেক কোণা দেখাও যায় না।।
প্যাসেঞ্জাররা কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে লাইন ধরেছে। ইমিগ্রেশন অফিসাররা কাচের ক্যাবিনে বসে পাসপোর্ট দেখে বোর্ডিং পাস দিচ্ছেন। তাদের পেছনে আটটা সোনালি মেটালের দরজা চোখে পড়ছে। এরপরেও অনেকগুলো দরজা আছে তবে সেসবের লাইন আলাদা।
অফিসাররা একেকজনের পাসপোর্ট দেখে একেকটা দরজার কাছে পাঠাচ্ছেন ।দরজা খুলছে, এক আধ মিষ্টি ঠান্ডা সুরভিত বাতাসের পশলা এসে প্রাণটা একেবারে জুড়িয়ে দিচ্ছে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে কারুকাজ করা হাইফাই অটোমেটিক গেট হলো গেট নাম্বার ওয়ান আর টু। তবে সহসা কেউ সেখানে যাচ্ছে না। অন্তত আহসান সাহেব দেখেননি যেতে। বেশিরভাগের কপালে গেট নাম্বার পাঁচ, ছয় পড়ছে অনেকের সাত আট । তাতেই বেশ তোড়জোড় করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে৷যাক এই দাঁড়ানো থেকে মুক্তি তো মিলল। রাজপুরীর মতো হলেও এয়ারপোর্টে বসে থাকতে কার ভালো লাগে?
আহসান সাহেবেরও বিরক্ত লাগছে।যদিও আহসান সাহেব অজস্রবার প্রবাস সফর করেছেন তবে কোন ফ্লাইটে এত বৈচিত্র্যময় সহযাত্রী দেখেননি। সোনালী চুল লাল চুল, কালো চুল; মিশমিশে কালো ছ’ফুট লম্বা কেউ আবার চার ফুটের বেশি নয়৷ এদের মধ্যে নিখুঁত সুপুরুষ আছেন আবার কেউ কেউ একেবার ক্ষুদ্রাকৃতির চোখের…। এর মাঝে কিছু বিখ্যাত মানুষও আছে যেমন একজনকে মনে হলো আরে সালাম আজাদ! বিখ্যাত গবেষক! তার তৈরি পেটেন্ট ফ্রি জীবন রক্ষাকারী ওষুধে অনেকের উপকার হয়েছে৷ তার দাতব্য সংস্থার জন্য অনেক দুস্থ শিশুরা পড়াশোনা করতে পারছে । এমন মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভালো লাগলো। এমন আরও কোন কোন সেলিব্রিটি আছে কিনা আহসান সাহেব চোখ ঘোরালেন।অচিরেই আরেক যাত্রীর দিকে স্থির তাকিয়ে রইলেন৷
কালিমুদ্দি মিয়া! আহসান সাহেবের এক কালিন বাড়ির দারোয়ান। ভালো স্বভাবের ভদ্র বিনয়ী, বিশ্বস্ত মানুষ ছিল । কিন্তু স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিল। দূরে কাজ করলে নাকি স্ত্রীর সেবা করতে পারবে না, কারণ শুনে আহসান সাহেব খুব বিরক্ত হয়েছিলেন৷স্ত্রীর প্রতি দরদ দেখিয়ে ভালো একটা চাকরি ছেড়ে বাসার সাথে লাগোয়া ছোট একটা পানের দোকান দিয়ে বাকি জীবন পার করেছে।প্রায় দিন আনি দিন খাই অবস্থা ছিল। এই লোক দূর প্রবাসের এত ঝলমলে এয়ারপোর্টের বোর্ডিং লাইনে কী করছে?অদ্ভুত তো! আবার তেমন সাজুগুজু নয়, গায়ে সেই ছাপোষা কাপড়ই পরা। তবে মুখটা হাসিহাসি৷ অসম্ভব অমায়িক হওয়ায় কেউ তাকে অপছন্দ কেউ করত না। কিন্তু তাই বলে কলিমউদ্দি এই খানে থাকবে?ক্যামনে কী?
” আরে দোস্তো তুমি এই খানে? ”
আহসান ঘুরে তাকিয়ে আরও হতভম্ব,
– সাদেক তুই !
” হ্যাঁ বন্ধু ভাবতেই পারিনি তোকেও পাবো।”
আহসান সাহেব হাসলেন। ছোটকালের বন্ধু সাদেক মোল্লা। সদা হাস্যমুখ সাদেককে বন্ধু মহলে খলিফা হারুন উর রশিদ বলা হয়৷ বিশাল দেয়ার হাত।তেমন ধনবান না হলেও বিপদগ্রস্ত বন্ধুদের বিশাল ত্রাণকর্তা । দিতে দিতে আজকাল কপর্দকশূণ্য। সেই মানুষও এই খানে! আহসান সাহেবের কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগছে।
” কী যে ভালো লাগছে এই অচেনাদের ভিড়ে তোকে দেখে ! ” সাদেক মহা উচ্ছাসিত, ” ভালো হয় যদি দুজন এক সাথেই এন্ট্রি পেয়ে যাই ”
” তাহলে তো খুবই ভালো হয় ” আহসান সাহেব স্বীকার করলেন।একা একা তারও ভয় লাগছিল।
” তা আন্দাজ করতে পারছিস তোর গেট কোনটা হবে? ”
” না রে দোস্তো। এটা পাসপোর্টের কোড দেখে এরা নাকি বলবে”
দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে সামনে আগাচ্ছেন। এর মাঝে মাঝে একটা দুটা দরজা খোলা হচ্ছে৷ এখন খোলা হলো তিন নাম্বার গেট, একজন হাসিমুখে ভেতর এন্ট্রি নিলেন। অপূর্ব টাটকা হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে গোটা এয়ারপোর্টে আবেশিত হয়ে গেল৷
এরমধ্যে দেখা গেল কালিমুদ্দিও বেশ এগিয়ে গেছে৷বোর্ডিং অফিসারদের ফেইস করছে৷ এখান থেকে শোনা যাচ্ছে কথোপকথন।
কালিমুদ্দি মিয়া?
” আস সালামু আলাইকুম স্যার ” কালিমুদ্দির মুখে ফোকলা দাঁতের চির পরিচিত হাসি।
-ওয়ালাইকুম আস সালাম! কেমন আছেন আপনি। যাত্রা পথে কোন সমস্যা হয়েছে ?
– জি না স্যার। একেবারে ঘুমাইতে ঘুমাইতে বড় আরামে আসছি৷
“এই ধরেন পাসপোর্ট! ”
ঝকঝকে সুদর্শন অফিসার হেসে কালিমুদ্দির ডান হাতে পাসপোর্ট দিয়ে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, ” যান আপনাকে বেশ অপেক্ষা করাবো না। গেইট নাম্বার দুই দিয়ে সোজা এন্ট্রি নিয়ে নেন।”
-গেট নাম্বার দুই? কালিমুদ্দি সহ তার আশেপাশের আরও কিছু মানুষ অবাক হয়ে তাকালো। এই পর্যন্ত বড় জোর গেট নাম্বার তিন দিয়ে কয়েকজন মানুষ প্রবেশ করেছে। কিন্তু কলিমউদ্দি কিনা পেলো একেবারে গেট নাম্বার দুই!
অফিসার বললেন “স্যার আপনার ভিসা তো মাশাল্লাহ সেই লেভেলের।গেট নাম্বার দুই ছাড়া উপায় আছে? মেনি মেনি কনগ্রেচুলেশনস। হাইয়ার অথারিটি দারুণ খুশি আপনার উপর। ইনজয় ইউর আল্টিমেট হলিডেজ ”
” শুকুর আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তোমার দয়ার সীমা নাই!” কলিমউদ্দিন আনন্দে ভাসতে ভাসতে গেট নাম্বার দুইয়ের সামনে দাঁড়ালো। অটোমেটিক সেন্সর লাগানো গেট দুইপাশে সরে গিয়ে খুলে গেল। এক পশলা মিষ্টি বাতাস আর স্নিগ্ধ আলো চোখে মুখে লাগতেই কালিমুদ্দির সাধারণ ছাপোষা চেহারায় জেল্লা খেলে গেল। বয়সও মনে হচ্ছে কমে গেছে অনেক।
আহসান সাহেব অবাক হয়ে বলল,” কপাল বলে একে!
সাদেক মাথা নেড়ে বললেন – কপাল নারে সার্ভিস। কালিমুদ্দি সেই রকম ডেলিকেটেট ছিল কাজে। শুনসিলাম তার প্যারালাইজড ওয়াইফটা নাকি আগেই এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে। একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়নি তবুও কালিমুদ্দি তার অসুস্থ ওয়াইফটাকে বেশ কেয়ার করতো৷ হাই কমান্ডের কাছে আসল রিপোর্ট যায় ”
-ওহ! আহসান সাহেব চুপ করে গেলেন৷ তবে সাদেক চুপ করার বান্দা না, সে বকে যাচ্ছে,” তোকে পেয়ে আমি
অদ্ভুত এক্সাইটেড বুঝলি। আমাদের ন্যুনতম চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে দেয় তাহলেই কেল্লাফতে। আমাদের বেগম সাহেবাদের তো এখনো খবর নাই। তুই আমি ইচ্ছামতো বিন্দাস গোটা জায়গা এক্সপ্লোর করব৷ তার সাথে সুপ্রিম কোয়ালিটির সার্ভিস৷”
” শুনেছি অথারিটি নাকি সেভেন সুপার মডেল কোম্পানিয়ন প্রোভাইড করবেন? “আহসান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন।
সাদেক মাথা ঘুরিয়ে তাকালো ” কিন্তু আমি শুনেছি পার হেড সেভেনটি সুপার মডেল কোম্পানিয়ন পাওয়া যাবে”
” সেভেনটি!”
” হ্যাঁ এখানে আসার আগে ব্রোসারস পড়িসনি? তবে আমি ওসব নিয়ে খুব একটা চিন্তিত না । এত দারুণ একটা জায়গা,মডেলদের সাথে টাইমপাস ছাড়া করার মতো কত কিছু আছে । আর মডেলরা তো মডেলই হয়। আমাদের আস্ত রক্তমাংসের মানবীর অভ্যাস ৷ওতে কি আর পোষাবে?একটু ধৈর্য ধরলে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বেগম সাহেবারা একবার এন্ট্রি করে নিলেই হলো ; তার আগে তুই আর আমি মিলে জায়গাটা এক্সপ্লোর করে ফেলব। কোথায় কোথায় ঝর্না আছে, কোথাও নাকি বরফ ঘেরা পাহাড় আবার নাকি মিউজিক্যাল জলপ্রপাতও আছে। আর ফলগুলোয় নাকি কোন বীজ নেই৷ আসলে এইখানের এগ্রিকালচার নাকি সেই লেভেলের … ”
সাদেক নিজের মতো বকবক করে যাচ্ছে আহসান সাহেবের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ” সেভেনটি সুপার হট মডেল! ” উত্তেজনায় বুকটা ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছে৷ সারাজীবন কর্মক্ষেত্রে অসংখ্য রূপবতী নারীসঙ্গের ইশারা পেয়েও বাজে ঝামেলায় তিনি জড়াননি। টাকা সুযোগ ক্ষমতা দুইই ছিল। নিজের ইমেজ ধর্মভীরুতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন৷ এখন সেটার রিওয়ার্ড হিসেবে সেভেনটির অর্ধেকও পায় তাইই বা কম কী! সাদেক তো শুরু থেকেই স্ত্রৈণ একটা৷ বউয়ের কথা উঠবস করা পাবলিক। কিন্তু আহসান সাহেব তেমন ছিলেন না। নাদিয়াকে তিনি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করেই চলতেন। হ্যাঁ চরিত্রহীনতাও তার মধ্যে তেমন ছিল না। তবে এখন যখন সুযোগ আছে আর জবাবদিহিতার ঝামেলা নেই তাহলে…. ৷ এর মধ্যে নাদিয়া উদয় না হলেই হলো। না মানে আসলে আসুক, একটু দেরি করে আসুক । হুট করে এসে শুধু শুধু ন্যাকা কান্না জুড়ে দেবে এমন একটা লাক্সারিয়াস হলিডের বারো বেজে যাবে। ভাবনায় ভাবনায় তাদের লাইন কখন এগিয়ে গেল খেয়াল রইলো না।ইমিগ্রেশন অফিসার হাসিমুখে পাসপোর্ট নিয়ে বললেন,
” মোহাম্মদ সাদেক মোল্লা সাহেব”
” জি আস সালামু আলাইকুম স্যার ”
” ওয়ালাইকুম আস সালাম স্যার! আপনার গেট নাম্বার তিন, কনগ্রেচুলেশনস ”
” গেট নাম্বার তিন! এত ভালো? ”
” কেন নয় স্যার,আপনার রিপোর্টও তেমন। প্রায় সব গুলো সেকটরে অসাম মার্কস! অলমোস্ট ৮০%। ইনজয় স্যার। এখানে সর্বাধুনিক সুপ্রিম সার্ভিস আপনাকে প্রভাইড করা হবে৷ আপনার নিজ চয়েসের সেভেনটি সুপার মডেল বেছে নিতে পারেন ক্যাটালগ দিয়ে দেয়া হবে…
” না না ওগুলোর তেমন আগ্রহ নাই। আমার ম্যাডামকে একটু তাড়াতাড়ি পাঠায় দিয়েন প্লিজ৷ আমার ওতেই হবে..নয়তো একা বোর হয়ে যাবো ”
” আচ্ছা স্যার আপনি এন্ট্রি তো নিন, ম্যাডাম সময় মতো আপনাকে জয়ন করুক আশাকরি। ”
সাদেক আহসান সাহেবের সাথে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন ৷ তিনি দাঁড়াতেই তিন নাম্বার গেটটা সুন্দর ভাবে খুলে গেল।আহসান সাহেব ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন। সাদেকেরও একটা ভালো জায়গা থেকে এন্ট্রি হয়ে গেল। এরপরই আহসান সাহেবের ডাক পড়ল। আহসান সাহেব দুরুদুরু বুকে পাসপোর্ট জমা দিলেন। পাসপোর্টের সাথে লাগোয়া মাইক্রোচিপে যাবতীয় ডাটা সংরক্ষণ করা। ইমিগ্রেশন অফিসার সেটায় আঙুল প্রবেশ করাতেই আহসান সাহেবের যাবতীয় প্রফাইল উঠে এলো হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে। আহসান সাহেব হিসেব করছেন।একটা দুটা বড় বিচ্যুতি ছাড়া কোন ব্যাড রেকর্ড ছিল না। যা ছিল এখানে আসবার আগেই সেগুলো সামলে ফেলা গেছে। কালিমুদ্দি নাহয় গরীব হওয়ায় হাইয়ার অথারিটির বেশি ফেবার পেয়েছে৷ তবে আহসান সাহেব নিজের জন্য আশা করেন সাদেকের মতোই তারও তিন নাম্বার গেটেই এন্ট্রি হবে।
” বাহ আহসান সাহেব, সমাজ সংস্কারক, সমাজসেবী, বিনয়ী, সৎ ব্যাবসায়ী, সবই একেবারে পারফেক্ট! দুটা ধর্মশালা এতিমখানা,স্কুল, দাতব্য হাস্পাতাল, দুস্থ আত্মিয়োদের সাহায্য, মাশাল্লাহ দারুণ প্রফাইল।”
– জি মেনি থ্যাংকস।
– আপনার এত ব্যস্ততার মধ্যেও অথারিটি অফিসে রেগুলার এটেন্ডেন্সটাও বেশ ইম্প্রেসিভ! দিনে পাঁচবারে বেশিরভাগই ইন টাইম ”
” জি এটা তো আমার ডিউটি ছিল। অবশ্য কর্তব্য। ”
” ফ্যামিলির থেকেও এ ওয়ান সার্টিফিকেট! সবই এক্সিলেন্ট…এমন প্রোফাইল কমই দেখা গেছে । আপনাকে তাহলে…”
ইমিগ্রেশন অফিসার দ্রুত হিসাব কষছেন কোন গেটের এন্ট্রি দেয়া যায়। এদিকে আহসান সাহেব মনে মনে ঠিক করছেন সেভেনটি সুপার মডেলের মধ্যে কার কার চেহারার কপি তিনি চান। ক্যাটালগ দেয়া থাকলেও নিজের পছন্দ মতো চেহারা ডিজাইন কি করা যাবে না?যাবার কথা। এখানে তো সব সুপ্রিম সার্ভিস৷
“এটা আবার কী? ”
ইমিগ্রেশন অফিসার ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছেন। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ত্রিমাত্রিক নক্সায় শেষবার চোখ বোলাতে বোলাতে আটকে গেছেন এক জায়গায়। আহসান সাহেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোনটা কী স্যার?
” না মানে আপনার ফ্যামিলি ক্লিয়ারেন্স ফাইলটায় সবার সার্টিফিকেট আছে, তবে একটা টেস্টিমোনিয়াল সার্টিফিকেট মিসিং”
” টেস্টিমোনিয়াল মিসিং? ”
” জি, আপনার ওয়াইফের সিগনেচার করা প্রশংসাপত্র, এইটা মিসিং ”
” না না সেটা কী করে হয়! সে এটা কেন দেবে না। আপনি একটু রি-চেক করুন প্লিজ। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। ”
“স্যার আপনি প্যারডাইজের সুপ্রিম লাউঞ্জে বসে সেখানকার দায়িত্বরত ইমিগ্রেশন অফিসারকে বলছেন কোথাও ভুল হচ্ছে! ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?”
আহসান দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন।সামনের চেয়ারে বসা দায়িত্বরত অফিসারের আইডিতে নাম লেখা রিজওয়ান৷ প্রশ্নটা রিজওয়ানের কিছুটা ইগোতে লেগেছে। যুবকটি বেশ কঠিন মুখ করে তাকিয়ে আছে৷ তার গাম্ভীর্যের মধ্যে একটা কড়া হুশিয়ারি লুকিয়ে আছে৷
আহসান সাহেব কোমল গলায় বলার চেষ্টা করলেন, স্যার আমারই একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি সম্ভবত এখানে আসার পথে ওর সার্টিফিকেটটা নিতে ভুলে গেছি৷ এটার জন্য কি কোন কম্প্রোমাইজ করা যায় না? ”
” না যায় না। রুলস আর রুলস। আপনার সব সার্টিফিকেটের কোড একসাথে মেইন ডাটাতে এন্ট্রির পরই সিস্টেম ডিসাইড করতে পারবে আপনার কোন গেটে এন্ট্রি হবে৷ আপনার ওয়াইফের সার্টিফিকেট সেখানে লাগবেই। কোন কারণ বশত তিনি সেটা দেননি। এই ক্ষেত্রে আমাদের আপনার জন্য অন্য ব্যবস্থা করতে হবে ‘
” অন্য ব্যাবস্থা মানে? ” আহসান সাহেবের প্যালপ্যাটিশন বেড়ে যাচ্ছে৷
” এক্ষেত্রে আপনার ডিপার্টমেন্টই চেঞ্জ করে দিতে হবে৷ ওই যে ওইদিকের অফিসারগুলোর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই আটটা সোনালি দরজা আপনার জন্য না। পেছনে দিকের যে লাল দরজাগুলো দেখেছেন না? ওইগুলোর কোন একটা দিয়ে আপনাকে এন্ট্রি করতে হবে৷ ”
আহসান সাহেব ঘুরে ঘরের একেবারে শেষ মাথায় বসা আরেকটা কাচঘেরা টেবিল দেখলেন৷ সাতফুট উঁচু লম্বা কঠিন মুখের দুজন ষন্ডা মতোন অফিসার বসে আছেন৷ চেহারা দেখে মনে হয় এক্ষুনি কাউকে বেধরক পিটিয়ে এসেছে, আরও ঠ্যাঙানোর জন্য মানুষ খুঁজছে। রক্তলাল চোখ দেখে পিলে চমকে যায়। ওইখানের লাইনের লোকগুলোও কেমন যেন ভ্যাজাল করছে। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করার বিপরীতে অফিসারদের কঠিন ধমক খাচ্ছে।
সব দেখে আহসান সাহেব ঢোক গিলে বললেন, ” আমি যদি ফিরে গিয়ে আমার ওয়াইফের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আসি? ”
” এখানে সব সময় ওয়ান ওয়ে টিকিট। আসার আগে এই বিষয়ে শক্ত ভাবে ব্রিফ করে দেয়ার কথা ৷ “রিজওয়ান বিরক্ত গলায় আরও বলল,” একটা কাজ করি আমি ওইখানে চালান করে দেই! আপনার সার্টিফিকেট নেই৷ নিশ্চয়ই ঝামেলা করেছেন বলেই নেই৷ আপনি এমনিতেই অনেক সময় নিয়েছেন৷ ওই দিকে চলে যান প্লিজ.. ”
” স্যার, স্যার, প্লিজ স্যার! একটু ম্যানেজ করেন। আমার রেকর্ড গুলো দেখেন আর প্রফাইলটাও দেখেন। প্লিজ স্যার। আমি একটা বার আমার ওয়াইফ নাদিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে চাই, একটা বার। কিছু একটা করেন স্যার। আমার এই আটটা গেটের একটায় ঢুকলেই হবে… ”
আহসান সাহেবের ক্রমাগত অনুরোধে রিজওয়ানের একটু দয়া হলো ” আচ্ছা একটা কাজ করি,এখান থেকে আপনাকে কল দেবার ব্যাবস্থা করে দেই। আপনি কথা বলেন। দেখেন উনি ওখান থেকে যদি টেস্টিমোনিয়ালটা মেইল করে দেন তাহলেও হবে ‘
অফিসার কল দিয়ে কাচের টুকরোর মতো ফোনটা আহসান সাহেবের হাতে দিলো।
” হ্যালো “নাদিয়ার কন্ঠ শুনে এই প্রথমবার আহসান সাহেবের কন্ঠ আর্দ্র হয়ে উঠলো। স্ত্রীর কন্ঠ এত মিষ্টি কখনো খেয়ালই করেননি।।
” হ্যালো নাদিয়া কেমন আছ?
নাদিয়া চুপ করে আছেন।যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না, এতদূর গিয়েও আহসান সাহেব ফোন দিয়েছেন!
” আমায় চিনতে পারছ? আমি আহসান! এত লম্বা সফর করে এসে তোমায় খুব মনে পড়ছে গো নাদিয়া ”
“কেন মনে পড়ছে? ওখানে সেবাযত্নের লোকের অভাব নাকি? ”
” তোমার অভাব নাদিয়া! তুমি ছাড়া আমার আর কেউ কোন খেয়াল রাখতে পারে বল? ”
” তাহলে এখন আমাকে ওখানেও দরকার আপনার যত্ন-আত্তির জন্য ”
” ওভাবে বলো না নাদিয়া। আমি তোমাকে খুব মিস করছি। এতই মিস করছি যে তোমার পারমিশন ছাড়া গোল্ডেন ডোর দিয়ে এন্ট্রি নিতেও ভালো লাগছে না ”
” সারা জীবন আমার পারমিশনের তোয়াক্কা না করা মানুষ এখন আল্টিমেট লাক্সারি গোল্ডেন গেট দিয়ে ঢুকতে পারছেন না। এইটা আমায় বিশ্বাস করতে হবে? ঝেড়ে কাশুন তো সোহরাবের আব্বা, ঘটনা কী? ”
আহসান সাহেব একটু যেন ভড়কে গেলেন। পৃথিবীতে থাকতে নাদিয়া কখনো এত রুক্ষ গলায় তার সাথে কথা বলেনি। মূলত সাহসই পায়নি। কিন্তু এখন সময় খারাপ, কিছু বিরক্ত লাগলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। মিষ্টি গলায় বললেন ” না মানে হয়েছে কি, তুমি আমায় যে টেস্টিমোনিয়ালটা দিয়েছিলে, ওটা আসলে আমার কোন ভাবে মিস হয়ে গেছে…। তোমার নিজের হাতের একটা স্মৃতি মিস হয়ে যাওয়া কেমন ব্যাপার না বল? সো ক্যান ইউ প্লিজ সেন্ট ইট টু মি ওয়ানস এগেইন? ”
” আমি তো আপনাকে কোন সার্টিফিকেট দেই নাই ”
” দাও নাই মানে? ”
” দেই নাই মানে দেই নাই। আপনি আমার কাছ থেকে চান নাই। সারাক্ষণ তো ঝাড়ির উপরই রাখতেন আগ বাড়ায়া কিছু করলে আরও বকা খাইতাম। ”
” মানে কী! এখন এই সার্টিফিকেট তো আমার লাগবে”
” ক্যান লাগবে, আপনার কি দামী সার্টিফিকেটের অভাব?এত না দিল দরিয়া, ভদ্র, অমায়িক, ধার্মিক, সাধু-পুরুষ। আপনার ভাষায় আমার মতো একজন মূর্খ, বোকা, বেগুণ, ভুল সর্বস্ব মেয়েমানুষ; যে নাকি আপনার জীবন হাবিয়া দোজখ বানায় দিসিল ; তার সার্টিফিকেট দিয়ে কি যায় আসে? আপনি আরামে আপনার সেভেন্টি সুপার মডেলদের নিয়ে টাইমপাস করেন, বেস্ট অফ লাক ”
” আরে বোকা মহিলা, সুপার মডেল কম্পেনিয়ন তো তখন পাবো, যখন তুমি ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট দিবা ”
এই নাদিয়া হাসলেন, “ওহো এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে, মানে সার্টিফিকেট দে! আমি সার্টিফিকেট না দিলে আপনে আর সত্তুর মডেলের সাথে ফুর্তি করতে পারবেন না। তা এই কথাটা এইখানে থাকতে মনে ছিল না? ”
আহসান সাহেব প্রমাদ গুনলেন রাগের বশত বেফাস কথা বলে ফেলেছেন। ওদিকে নাদিয়া পুরো মেজাজে এসে বলে চলেছেন,” সারাজীবন তো আমি কত বোকা, কত ভুল ত্রুটির ভান্ডার এই চিন্তায় বসে থাকতেন। দুনিয়ার মানুষের সাথে মিষ্টি কথা, সুন্দর ব্যবহার করতেন। আর বাসায় ফিরে আমারে দেখেই মাথার তালু গরম হয়া যাইতো৷ আমার সাথে মিষ্টি করে একটা কথা বলতে আপনার চোয়াল ব্যথা করত। ভুল হইত কি না হইত, আমি সাথে সাথে আপনার কাছে মাফ চায়া নিতাম।কিন্তু আপনে তো মহামানব, আপনার কোন ভুল হয়ই নাই। তাই মাফও চান নাই, এখন এত কান্দন আসে ক্যান? ”
” নাদিয়া প্লিজ দেখ আমি স্যরি … ”
আহসান সাহেব কথা বলতে পারলেন না, টের পেলেন পেছনে একদল উঁচু লম্বা লোক এসে দাঁড়িয়েছে।তার আর বেশি কথা বলার সুযোগ নেই।সুক্ষ্ম ভয় হচ্ছে তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেওয়া হবে।
ওপাশ থেকে নাদিয়া বলছেন ” আপনে স্যরি বলতে দেরি করে ফেলসেন।এখন অপেক্ষা করেন। আমার মুড ভালো হলে দ্যান আই উইল থিংক এবাউট ইট। ততক্ষণ পর্যন্ত প্লিজ ম্যানেজ করে নিয়েন”
” নাদিয়া নাদিয়া শোন…” আহসান সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না পেছনের লোকগুলো তাকে চ্যাং-দোলা করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের কোনার দিকের লাইনে।
” ওকে স্যার অনেক কথা হইসে এখন ম্যাডাম সার্টিফিকেট যতক্ষণে অথারিটিতে মেইল না করছেন, আপনি আমাদের ওয়েটিং রুমে থাকবেন। এখন আসেন! পুলসিরাত এয়ারপোর্টে মাঝেমধ্যে কতগুলো ক্যাচাইলা পাবলিক এসে পড়ে! ”
আহসান সাহেব প্যারাডাইস লাউঞ্চের লাইন থেকে ছিটকে সরে আসছেন লাল দরজা গুলোর কাছে। প্রচন্ড গরমে গা দিয়ে ঘাম ঝরে যাচ্ছে..। গোটা এলাকাটা যেন আগুনে মোড়া…। মেঝেতে মাথা কুটে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই একটা সার্টিফিকেট এর জন্য গোটা ভাগ্যটাই উলটে যাচ্ছে৷ কড়া উত্তাপে লাল দরজার ওপারেই চামড়া ঝলসে যাবার জোগাড়৷ আহসান সাহেবের প্রচন্ড ভয় লাগছে,, সাথে সঙ্গীদের আপসোস শুনতে পারছেন ” ইশ রে এরে বলে কপাল। বেচারার সবই ঠিক ছিল,শুধু একটা সার্টিফিকেটই মিসিং!আপসোস, বড়ই আপসোস ”
