লেখক কিন্তু যে কেউ হতেই পারে, কিন্তু সাহিত্যিক কজন হয় সেটা ভেবে দেখা দরকার | শারমিন আঞ্জুম
শুভ নববর্ষ। দুই বছর ভাইরাসের ভয়ে গৃহবন্দী থাকার পর এবারের নতুন বছরের সূর্য আমাদের কাছে হাজির হয়েছে আশার এক নতুন কিরণ নিয়ে। পৃথিবী একটু একটু করে সেরে উঠছে, প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। নিকষ অন্ধকারে গুমোট সেই সময়টাতে আমাদের এক মুঠো স্বস্তি দিয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে অনেক ফ্রন্টলাইনারদের পাশে লেখকরাও আছেন বলে আমি মনে করি। ফেসবুক প্লাটফর্মেই হোক, বা ছাপার অক্ষরে, যারা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, নির্মল আনন্দ দেই, চিন্তার খোরাক জোগায়, হাসায়, কাঁদায় তাদের মধ্যে অন্যতম একজন লেখক শারমিন আঞ্জুম। কন্যা রাশির জাতিকা শারমিন আঞ্জুম এর জন্ম ১৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকায়। বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনাও এই শহরেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতি অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাবা এ কে এম সামসুল হক এবং মা তৌহিদা হকের দ্বিতীয় সন্তান। প্রকৌশলী স্বামী মাহবুবুল আলম ও দুই পুত্র সন্তান আবিয়াজ ও আরিজ আলমকে নিয়েই তার ছোট্ট সুখের সংসার। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি দুর্দান্ত ছবি আঁকেন। আর ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে। ইতোমধ্যে তাঁর চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। থ্রিলার, সামাজিক, রোমান্টিক, হরর সব ধরনের জনরায় তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন৷ প্রথম উপন্যাস থ্রিলার “নির্বাসন”, দ্বিতীয় উপন্যাস “কিছু না বলা কথা”, তৃতীয় বই হরর থ্রিলার জনরার ‘আমারে দেবনা ভুলিতে’, চতুর্থ উপন্যাস ‘প্রিয় চন্দ্রিমা’ সবগুলোই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। এবারের বইমেলায় চলন্তিকা প্রকাশনী থেকে এসেছে তাঁর উপন্যাস “দ্রোহত্রয়ী”, এবং তাঁর সম্পাদিত থ্রিলার উপন্যাস “ভাঙা কাঁচের আয়না”। চলুন বাকিটা জেনে নেওয়া যাক লেখকের মুখ থেকেই।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা হোসাইন মিমি।
শারমিন আঞ্জুম
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ মিমির আলাপচারিতায় আপনাকে স্বাগতম আপু। কেমন আছেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি আপু।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ শুরুতেই আপনার শৈশব আর বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই।
শারমিন আঞ্জুমঃ আব্বা আম্মা দুই বোন একভাইয়ের মধ্যবিত্ত একক পরিবার ঢাকায় জন্ম বেড়ে ওঠা। একেবারে সাধারণ শহুরে জীবন ছিল। আমি বাকি ভাইবোনদের থেকে কিছু দুর্বল ছিলাম। তবে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভও ছিলাম। সারা বাড়ির দেয়ালে আমার আঁকা বিভিন্ন ছবি থাকতো ।সে ছবির পেছনে গল্পও থাকতো। ছোটবেলায় আঁকার জন্য প্রচুর ক্রেস্ট পেয়েছি। পড়াশোনায় তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। ভালো রেজাল্ট বা ভালো ছাত্র ছাত্রীর খেতাব আনা মূলত আমার বাকি ভাইবোনগুলোর দায়িত্ব ছিল।এই দিক থেকে আমি এক অর্থে বেঁচে গিয়েছি বলা যায়। আমার পড়ার চাপ ছিল না। নানুবাড়ির পরিবার কিছুটা রক্ষণশীল হলেও আমার দাদুর বাড়ির সবাই ছিলেন দারুণ রকম সংস্কৃতিমনা। নাচ, গান, আবৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ে মোটামুটি কমবেশি সবাই দক্ষ। যার কারণে আম্মুর দিকে না হলেও আব্বুর দিক থেকে আঁকাউঁকিতে পর্যাপ্ত উৎসাহ ছিল। বাবা মায়ের শাসন ভাইবোনের খুনসুটি মারামারিতে সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব ছিল।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ ছোটোবেলায় সবাইকে একটা কমন প্রশ্ন শুনতে হতো। বড়ো হয়ে কী হতে চাও? আপনি বড়ো হয়ে কী হতে চাইতেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ শিল্পী । আমি বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হতে চাইতাম ।কারণ এটাই আমার জন্য সহজ ছিল।আহামরি উচ্চাশা আমার ছিল না পরিবারের বাকি সবাই অর্থাৎ শুধু আব্বুই নয় চাচা ফুপিরা সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে পড়াশোনা করেছে বেশিরভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে৷ বড় কিছু হতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়, মোটা মোটা বই পড়তে হয় এটা আমার জানা ছিল। কিন্তু তত্ত্বীয় পড়াশোনা আমায় কেন যেন টানতো না। এই জন্য বড় কোন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কিছু হবার আমার আগ্রহ ছিল না। মূলত ঝামেলাদায়ক কোন কিছুর মধ্যে যেতেই চাইতাম না। ভালো ছাত্র ছাত্রী হবার অপরাধে ওসব হবার দায়িত্ব আমার বড় বোন আর ভাইয়ের উপর ন্যাস্ত ছিল।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার লেখালেখির ব্যাপারে তাদের অনুভূতি কেমন?
শারমিন আঞ্জুমঃ সামাজিক বিচারে মেয়েদের সাধারণ দুটা পরিবার থাকে। একটা পরিবার হলো সেটা যেখানে সে জন্মেছে আরেকটা সেটা যেটায় সে নিজে সন্তান জন্ম দিয়েছে৷ যে পরিবারে আমি জন্মেছি সেটার ব্যাপারে আগে বলি, আব্বা আম্মা তিন ভাইবোনের শহুরে একক পরিবার ছিলাম৷ আব্বু প্রকৌশলী আম্মু প্রাক্তন শিক্ষিকা। তবে তখনকার দিনে আমাদের জীবন এত যান্ত্রিক ছিল না। একক হলেও গোটা পরিবারের বাকি বন্ধনগুলো বেশ শক্ত ছিল চাচা ফুপি মামা খালামনিদের ছেলে মেয়ে অর্থাৎ কাজিন বন্ডিং খুব চমৎকার ছিল। সবাই এক হলে দারুণ একটা উৎসব হতো। আমি সেগুলো উপভোগ করেই বড় হয়েছি৷বর্তমানে আব্বু মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী এ কে এম সামসুল হক, আম্মু তৌহিদা হক ; আমার বড়বোন ডাক্তার শায়লা শবনম বর্তমানে সৌদি মিনিস্ট্রি অফ হেলথে কর্মরত চিকিৎসক, আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই সাইদুল হাসান একজন ব্যাংকার আর আমি সর্বাধিক অলস এক সময় শিক্ষকতা করতাম এখন কিছু লেখালেখি করি এইতো৷ তিন ভাইবোনের সবাই বিবাহিত এবং সন্তানের বাবা মা।
আমার নিজের পরিবার বলতে স্বামী ও দুই পুত্র নিয়ে ছোট পৃথিবী। আমার স্বামী মাহবুবুল আলম পেশায় শ্বশুরের মতোই প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী। বড় ছেলে আবিয়াজ বর্তমানে ক্লাস এইটে ছোট ছেলে আরিজ আলম ক্লাস ওয়ানে ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে। লেখালেখির ব্যাপারে দুই পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই পজেটিভ৷এবং এটা খুব জরুরিও। সৃজনশীল কিছু পজেটিভ পরিবেশ ছাড়া সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ আমার লেখালেখি দেখে কাছের মানুষরা কিছু অবাক হয়েছিলেন। কারণ তারা আশা করেছিলেন যে আমি হয়তো ছবি আঁকার উপর কিছু করব। তুলি ফেলে হুট করে কলম ধরায় সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। তবে আব্বা শুরু থেকে পড়ুয়া মানুষ তিনি তো যথেষ্ট খুশি। তবে অন্ধভক্ত না হয়ে আমার লেখালেখির গঠনমূলক সমালোচক তিনি। কীভাবে লেখা আর শানিত হতে পারে সেটার তিনি পরামর্শ দেন৷ আমার সাহেবও পর্যাপ্ত সাপোর্টিং সেই সাথে দুই ছেলে৷ সাংসারিক কাজ টেনশন কড়া দায়িত্ব সৃজনশীল ক্ষমতাগুলো কিন্তু ভোঁতা হয়ে যায়। এটাকে ধারালো করতে হলে নিয়মিত চর্চা করতে হয়। ফ্যামিলির কাছ থেকে পাওয়া স্পেসের কারণে আমি এগিয়ে যেতে পারছি। আলহামদুলিল্লাহ।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার বাবা তো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার সম্পর্কে কিছু বলুন।
শারমিন আঞ্জুমঃ উনিশশো একাত্তর সালে তড়িৎ প্রকৌশলে পাস করার পরপরই আমার আব্বা এ কে এম সামসুল হক ছাব্বিশ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি সেক্টর দুইয়ে দায়িত্বরত ছিলেন। একজন দেশ প্রেমিক ও সৎ নাগরিক। মুক্তিযোদ্ধা হবার কারণে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি যে সুযোগ সুবিধা পেতে পারতেন তার কিছুই তেমন নেননি৷ তার কথা ছিল “আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, দেশকে ভালোবেসেছি তার বিনিময়ে কেন কিছু চাইব? ” নিঃসন্দেহে এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়।আক্ষরিকভাবে একজন সাহসী ও সৎ মানুষের সন্তান হওয়াটা যেমন সৌভাগ্যের তেমনি দারুণভাবে দায়িত্বেরও। যেকোনো ভারী পদক্ষেপ নেবার আগে দুইবার ভাবতে হয় যে আমার জন্য এটা সঠিক কি না। আমার কোন কর্মে আমার আব্বার মাথা হেঁট হয় কি না। মুক্তিযোদ্ধা হলেও ব্যক্তিগত জীবনে আব্বা খুব নির্বিবাদী মানুষ৷ কিছুটা নিভৃতচারী এবং অসম্ভব পড়ুয়া মানুষ। সেই ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, ইতিহাস সহ নানান জ্ঞান বিজ্ঞানের বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করে জবাব পাইনি এমনটা কখনো হয়নি।তখন আমি যতটা বিস্মিত হতাম আজ আমাদের বাচ্চারাও তার নানাকে দেখে ততটাই বিস্মিত। সব সময় নলেজ আপডেট রাখা একজন আধুনিক মানুষ হলেন আমার আব্বা।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনি এক সময় শিক্ষকতাও করতেন। সেটা ছেড়ে দিলেন কেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ ছাত্র পড়ানো খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা দায়িত্ব। পেশাগত ভাবে অসম্ভব একাগ্রতা প্রয়োজন। তার সাথে লাগতো অসম্ভব বাকপটুতা।সমস্যা হলো ক্লাসে আমার অনর্গল কথা বলতে তেমন ভালো লাগতো না। অথচ এক একটা বাচ্চার ভেতর প্রশ্নের বিশাল ভান্ডার,অতল গহীন তাদের কৌতুহল। আর একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পড়িয়ে যাওয়া নয়, ছাত্রদের ভেতরের আত্মবিশ্বাসটা তৈরি করে দেওয়া। মূলত শিক্ষকের কঠিন দায়িত্বটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বলেই মনে হলো এত ধৈর্য আমার বোধহয় নেই৷ পেশাগত ভাবে এইজন্য শিক্ষক আর থাকতে চাইনি। তবে নিজেস্ব নৈতিকতা, জীবনবোধকে ব্যক্ত করার মাধ্যম অনেক আছে। আক্ষরিক অর্থে সেক্ষেত্রে শিক্ষক হয়ত না হলেও চলে।
লেখক কিন্তু যে কেউ হতেই পারে, কিন্তু সাহিত্যিক কজন হয় সেটা ভেবে দেখা দরকার | শারমিন আঞ্জুম
শারমিন আঞ্জুমের গল্প সার্টিফিকেট পড়তে ক্লিক করুন
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে? এবং কিভাবে?
শারমিন আঞ্জুমঃ আজ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না আমি আসলে লিখতে চাইতাম না। অতএব লেখক হবার বাসনাও কোনদিন ছিল না।শুরু থেকেই আমি দারুণ ফাঁকিবাজ অলস ধরনের স্টুডেন্ট ছিলাম। ফাইভ সিক্সে গিয়ে যখন ব্রড কুয়েশ্চন নামক যন্ত্রণাটা শুরু হলো, আমি বিষয়টা ধরতে পারলাম না। চার পাঁচ লাইনে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে কেটে পড়তাম। বড় প্রশ্নের উত্তর গুলো যে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিতে হয় আমার জানা ছিল না।কাজেই মার্ক কম পেতাম।
এদিকে পাতার পর পাতা নোট মুখস্থ আমার ধৈর্যের বাইরে। উপায় না দেখে আমার তৎকালীন যিনি টিউটর ছিলেন তিনি আমায় ডাইরি লিখতে বললেন। প্রতিদিনের দিনলিপি লিখে রাখতে হবে, আজ কী হলো, কোথায় গেলাম, কী খেলাম..এইসব আরকি।আমি লিখতাম। তিনি প্রতিদিন পড়াতে এসে সেগুলোও পড়তেন । প্রতিদিনের ঘটনাবলী নিজের ভাষায় বর্ণনা করতে করতে কেমন যেন নেশা লেগে গেল। আমার মনে হলো প্রতিদিনের ঘটনাই নয়, পৃষ্ঠাগুলোতে আমি নিজের অনুভূতিগুলো বন্দী করে রাখছি। একটু একটু করে কিছু কাল্পনিক গল্পগুলোকেও আকার দেয়া শুরু করলাম অক্ষরের মধ্যে। আঁকার সাথে সাথেই খাতায় টুকটাক লিখতে শুরু করলাম । তবে বিশাল দুঃখের বিষয় আমার এই সুপ্ত প্রতিভার কদর ছোটকালে হয়নি।আমার বাকি দুই হিংসুক ভাইবোন লুকিয়ে সেগুলো পড়ে পড়ে অন্যদের শোনাতো আর হেসে গড়াগড়ি খেতো। এই ভীষণ দুঃখে মাঝখানে সাহিত্য চর্চা ছুটেই গিয়েছিল৷ এরপর আবার অনার্সে থাকতে লিখতে শুরু করলাম। তখন কিছুটা ম্যাচিউরিটি এসেছে। একটা রোমান্টিক গল্প লিখেছিলাম নাম ছিল নাম হলো প্রিয় চন্দ্রিমা। তবে সেটাও সেমিস্টার ফাইনাল আসার কারণে বন্ধ হয়ে গেল৷ আমি তখন পরীক্ষার তোড়জোড়ে লেগে গেলাম ভাবলাম অনার্সের পর নিশ্চয়ই শেষ করব। শেষ করেছিলাম ঠিকই তবে অনার্সের প্রায় এক যুগ পরে। কারণ অনার্সের ঠিক চার দিন আগে আমার বিয়ে হয়ে যায়। এর একযুগ পর আমি আমার সেই অসমাপ্ত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটা উদ্ধার করি বাবার বাড়িতে আমার পুরাতন পড়ার টেবিলে।ততদিনে অনলাইনে আমার প্রথম উপন্যাস বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। খাতায় লেখা গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম, মনে হল প্লটটা একেবারে খারাপ না, আরেকটু ম্যাচিউর করে লিখলে ভালো লাগবে। ততদিনে জীবনবোধে গভীরতাও এসেছে তাই নতুন করে লেখা ধরলাম এবং শেষ করলাম । প্রিয় চন্দ্রিমা আমার সেই প্রথম লেখা উপন্যাস ( যদিও শেষ হয়েছে প্রথম উপন্যাসের পরে) আর তৃতীয় প্রকাশিত বই। এটা রোমান্টিক ঘরানার একটা পাঠকপ্রিয় বই।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ প্রথম প্রিন্ট মিডিয়ায় আত্মপ্রকাশ হয় কবে? এবং কোন লেখা বা বই দিয়ে?
শারমিন আঞ্জুমঃ আমার প্রথম প্রকাশিত বই রোমান্টিক থ্রিলার জনরার নির্বাসন যেটা প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের বইমেলায় পেন্সিল পাবলিকেশন থেকে। এখন দেশ প্রকাশনী থেকে বইটির চতুর্থ এডিশন যাচ্ছে।।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ কোন ঘরানার লেখায় আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ আমি কোন জনরায় নিজের লেখাকে আটকে রাখতে চাই না। রোমান্টিক, সামাজিক, থ্রিলার হরর সব জনরার লেখায় চেষ্টা করে যেতে চাই। হয় কতটা তা ঠিক জানি না। আমার মতে লেখকের নিজের তৃপ্তিটাই তার স্বাচ্ছন্দ্য। এই পর্যন্ত আমি আমার লেখা উপভোগ করেছি৷ থ্রিলার কিছুটা কঠিন কারণ ছক কষে যুক্তি ও দর্শনকে সমন্বয় করে লিখতে হয় তবুও এটা লিখার আনন্দ অন্যরকম আবার সামাজিক লিখাটা কিছু ক্ষেত্রে সোজা কিন্তু মানসম্মত করতে গেলে ভাষা, ম্যাসেজ ইত্যাদি বিষয়ে খেয়াল রাখা লাগে। কাজেই সব জনরায় আলাদা আলাদ চ্যালেঞ্জ আছে।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ লেখালেখির জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় বা রুটিন কি মেইনটেইন করেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ না করিনা৷ সময়টা নির্ভর করে মুডের উপর। অবসরে লিখি এটা সত্যি। তবে কোন গল্প মাথায় নেশার মতো চড়ে গেলে দিনরাতের কোন চিন্তা আমার থাকে না। সাধারণত লেখালেখিটা শুরু হয় একেবারে নিস্তব্ধ পরিবেশে, গভীর রাতে।এই সময় টানা লিখে যাওয়া যায়, অন্য কোন চিন্তা মাথায় থাকে না, লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবার অবকাশ থাকে। এই সময়টা গভীর রাত হতে পারে বা একেবারে খালি বাড়িতে একাও হতে পারে৷ কিছু কিছু দিন যায় সারা দিন টানা লিখেছি। কারণ লেখার পুরো মুডে আছি বাড়িতেও কেউ ছিল না। ল্যাপটপের সামনে কখন বসেছি খেয়ালও নেই। শুধু লিখে গেছি। আবার এর পরে অনেক দিন লেখায় মুডই হয় না৷ ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও তাই। অনেক ছবি আশিভাগ আঁকার পরে পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। এরপর আবার মুড হয় এক বসায় শেষ করে দেই। দিন রাত নিয়ম করে আমার কোন সৃজনশীল কাজই আগায় না।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার নিজের কাছে আপনার সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটি?
শারমিন আঞ্জুমঃ আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখা এখনো আমি লিখিনি বলেই মনে হয়৷ কম বেশি সব গল্প নিয়ে আমার অতৃপ্তি আছে। প্রতিটি গল্প লেখার সময় আমি নিজের শতভাগ দেবার চেষ্টা করি। তবুও আমার মতে পারফেক্ট বলে কিছু এখনো হয়নি। তবে দ্বিতীয়বার ভাবলে মোহমেঘ উপন্যাটা কিছুটা প্রিয়। এই লেখাটা আমায় নিজের সীমা ভেঙে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছিল। প্রথম প্রাপ্ত মনস্ক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ছিল এটা। উত্তম পুরুষে লেখার কারণে ন্যারেশনেও ঝামেলা ছিল। তবুও মোহমেঘ মনে হয় আমার একটু বেশি প্রিয়।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ রহস্যলীনার সাথে কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন? কেমন লেগেছে রহস্যলীনায় কাজ করতে?
শারমিন আঞ্জুমঃ রহস্যলীনা দুইয়ে আমার এই জনপ্রিয় সিরিজের সাথে যাত্রা শুরু। সম্পাদক ফৌজিয়া আপু আমার প্রিয় মানুষ প্রিয় ব্যক্তিত্ব রহস্যলীনা একের অসামান্য জনপ্রিয়তার কারণে বইটা নিয়ে আগ্রহ ছিল। ফৌজিয়া আপু নিজেই একদিন আমায় নক করলেন। মোটামোটি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। নামীদামী লেখক যাদের আমি নিজেই ভক্ত তাদের সাথে এক প্রচ্ছদ শেয়ার করার লোভ সামলানো যায়নি৷রহস্যলীনার সাথে কাজের অভিজ্ঞতাও চমৎকার। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হলো থিম ধরে নির্দিষ্ট শব্দ সংখ্যার মধ্যে গল্প লেখার প্রসেসটা৷ লেখকদের জন্য এটা দারুণ একটা প্রেকটিস।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃআপনার নিজের সম্পর্কে এমন তিনটি তথ্য দিন যা পাঠকরা জানে না।
শারমিন আঞ্জুমঃ *আমি অসম্ভব অলস। আলস্যতার জন্য বড় বড় সুযোগ হারিয়েছি।
*আমি রাঁধতে খুব ভালোবাসি।
*আমি একজন এন্টিক কালেকটর। আমার এন্টিকের বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করার নেশা আছে। পুরনো বাসন, ফার্নিচার, গয়না এমন বেশ কিছু আমার কালেকশনে আছে।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার সেন্স অব হিউমার এর ভীষণ প্রশংসা সবার কাছে শোনা যায়। রম্য লেখার প্ল্যান আছে?
শারমিন আঞ্জুমঃ মানুষের হিউমার সেন্স তার বিশাল একটা গুণ, বিশেষ করে লেখকদের জন্য।কারণ মানুষকে কাঁদানো যত সহজ হাসানো ভয়ংকর কঠিন। এই বৈশিষ্ট্য আমার যথেষ্ট মনে হয় নেই।তবু চেষ্টা করে যাই। আমি কয়েকটা রম্য ছোট গল্প লিখেছি৷ তবে সেগুলো প্রকাশে আসেনি৷ যখন মুড আসে আমি কিন্তু রম্যও লিখি৷ একটা উপন্যাসও লেখার ইচ্ছে আছে রম্য স্টাইলে। দেখা যাক।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা শুনে আপনাকে অনেকে রাগী ভাবেন। যদিও আমি আপনাকে সদা হাস্যোজ্জ্বল দেখেছি। আসলে কি আপনি খুব রাগী?
শারমিন আঞ্জুমঃ আমার ধারণা আমার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধ নেই। হ্যাঁ কিছুটা সরাসরি কথা বলতে আমি পছন্দ করি,এটাকে অনেকে রাগ হিসেবে ধরে নেয়। তবে আমার মনে হিয় স্বচ্ছতার মধ্যে একটা সৌন্দর্য আছে। আর রাগের ক্ষেত্রে বলতে হবে দশজন মানুষ যে কারণে রেগে যাবে আমিও সেই কারণেই রেগে যাই। যেমন চাটুকারিতা আমার দুই চোখের বিষ।অন্যায়, অনাচার, কপটতা,ছলনা, মিথ্যা অহংকার এইসব বিষয় দেখে আমার রাগ লাগে৷আমি সেগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা কম করি। অন্তত নিজের আপত্তিটা প্রায় সাথে সাথেই জাহির করি। রাগটা চেপে যাই না।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ লেখালেখি ছাড়াও আরো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আপনি। ছবি আঁকা, ফুডোগ্রাফি, বুক রিভিউ… সবকিছুতেই অনবদ্য। এতো কিছু ম্যানেজ করেন কিভাবে?
শারমিন আঞ্জুমঃ লেখালেখিতে কিছু পরিচিতি পেয়েছি তবে আমি নিজেকে আজও আগে শিল্পী ভাবতেই পছন্দ করি। ক্যানভাস আর তুলি আমার প্রথম প্রেম৷আগেই বলেছি লেখাটা পুরা ব্যাপারটা মুডের উপর নির্ভর করে৷ লেখার কাজেই অনেক সময় তুলিও ধরতে হয়। কিছু কিছু সিক্যুয়েন্স বা ক্যারেক্টর আমি নিজ হাতে পোর্ট্রে করতে পছন্দ করি। লিখতে গিয়ে স্ট্রেস এসে গেলে লেখা বন্ধ করে তুলি ধরে মনটাকে শান্ত করি৷ বড় একটা উপন্যাস শেষ করার পর দেখা যায় ক্যানভাসে ফিরছি৷ ছবি আঁকার জ্ঞানটা আছে বলেই ক্যামেরার ফ্রেমিং, কম্পোজিশন এই বিষয়গুলো আমার জন্য কঠিন না। সব শিল্পীরাই সম্ভবত ভালো ফোটোগ্রাফার তবে সব ফোটোগ্রাফার কিন্তু শিল্পী নয়৷ এই কারণে হয়তো মাঝেমধ্যে ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কিছু ভালো ছবি উঠে গেছে। আর রিভিউয়ের ক্ষেত্রে বলতে হবে আমি যত ভালো লেখক, তার থেকে ভালো পাঠক । প্রচুর বই পড়ি। জনরা বা লেখক বাছ বিচার করি না। খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস আমার। যার কারণে চেষ্টা করি গঠনমূলক ভাবে বইটা নিয়ে আলোচনা করতে। ভালো রিভিউ হয় কি না জানি না।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ কখনো খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে?
শারমিন আঞ্জুমঃলেখকরা আসলে বইমেলাতেই স্টার। দারুণ রকমের খ্যাতিমান লেখক যারা ভক্তদের দ্বারা বিড়ম্বনায় পড়েন, বাংলাদেশের তেমন লেখক অল্প কয়েকজনই এসেছেন। বাকি পাঠকদের ভালোবাসা সব লেখকই মনে মনে উপভোগ করেন। হ্যাঁ মেলায় গেলে কিছু স্টল থেকে সহসা ছাড়া পাওয়া যায় না৷
মনে আছে একবার এক পাঠকের সাথে দেখা তিনি নাকি ” কিছু না বলা কথা ” পঁচিশবার পড়েছেন। বইয়ের যেকোনো অংশ ধরলে তিনি পরের লাইন মুখস্থ বলে দিতে পারবেন। শুনে আমি হতভম্ব।সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার বই কেউ মুখস্থ কেন করবে? তিনি খুব জোর করছিলেন যেন আমি তাকে মুখস্থ ধরি। যদিও ধরিনি।
একবার এক পরিবারের তিন প্রজন্মের সাথে দেখা হয়েছে, যারা সবাই আমার বই একাধারে পড়েছেন৷ তাদের মধ্যে আমার দাদুর বয়সী একজন পাঠক আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছেন। অনেক দোয়া করেছেন। আমার জন্য এই অভিজ্ঞতাগুলো সম্পদ, বিড়ম্বনা নয়।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ বড়ো বড়ো লেখকদের আত্মজীবনী লেখার একটা বাসনা থাকে। পাঠকও চায় সেসব পড়ে প্রিয় লেখক সম্পর্কে জানতে। আপনার এমন কোনো বাসনা আছে?
শারমিন আঞ্জুমঃ না নেই। কিছু গল্প নিজের জন্য রেখে দেওয়া ভালো বলে আমি মনে করি। আমার জীবনবোধ দিয়ে আমি গল্প বলে যেতে চাই তবে জীবনের সত্যি গল্পটা নিজের জন্যই থাক।ওটা বিচারের অধিকার কাউকে দিতে চাই না।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ বর্তমান প্রজন্ম বই পড়তে চায় না কেন বলে আপনার মনে হয়? এর পেছনে কী শুধু ডিভাইসের যথেচ্ছ ব্যবহার দায়ী? নাকি আরো গভীর কোনো কারণ আছে?
শারমিন আঞ্জুমঃ বর্তমান প্রজন্ম বই পড়তে চায় না ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয় কিন্তু। বই পড়ুয়াদের সংখ্যা বরাবরই একটু কমই ছিল। আমাদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে ড্রইংরুমে বিশাল বিশাল তিনটা বই ভরা আলমিরা দেখে চোখ কপালে ওঠাতো -এত্ত বই! কে পড়ে? ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালিদের জন্য বই পড়া সময় নষ্টের মতো ছিল। তাদের শুধু পাঠ্যবইটাই একমাত্র মুক্তির উপায় মনে হতো। কারণ পাঠ্যবই থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রি তাদের একটা সম্মানজনক জীবিকা দেবে। গল্পের বই পড়ে সময় নষ্ট করতে তারা চাইতো না। এখন পড়ার ব্যাপারটা আরও সহজলভ্য হয়ে গেছে ফেসবুকের কল্যাণে। নতুন নতুন সিমে ফ্রী এমবি।। নতুন লেখকরা পাঠক তৈরি করতে গল্প শেয়ার দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন ফ্রী মিডিয়ায় গল্প পেয়ে গেলে কেইবা বই কিনে পড়তে চাইবে? তার সাথে বিনোদনের আরও অনেক মাধ্যম খুলে গেছে আগে যেটা বই দিয়ে পূরণ করা যেত সেটা আরো সহজলভ্য নতুন কিছু মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই বইটা কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়ে গেছে।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ লেখকদের এক্ষেত্রে কী ভূমিকা থাকা উচিত? তারা এই জেনারেশনের চাহিদা অনুযায়ী লিখছে না বলে কী তারা পড়ছে না? বা আপনি নিজে কী কখনো পাঠকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে লেখেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ আমি বলব লেখকরা পাঠক আকর্ষণ করতে বইয়ের যদি একটা মানসম্মত ভাবে প্রচার করে সেটা করতেই পারে। একটা কথা মনে রাখতে হবে লেখক কিন্তু যে কেউ হতেই পারে, কিন্তু সাহিত্যিক কজন হয় সেটা ভেবে দেখা দরকার। একজন গল্পকার গল্প লিখবেন তার চলমান সময়কে উপজীব্য করে, না অতীতে গিয়ে সেটা তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন ; তবে লেখা উপস্থাপনে যথেষ্ট আকর্ষণ না থাকলে পাঠক পাবে না৷ জেনারেশনের চাহিদা না ভেবে আমার মনে হয় জেনারেশনটাকেই মাথায় রেখে গল্পগুলো সাজানো উচিত। ভারী শব্দব্যঞ্জন দিয়ে গুরুপাক কিছু না রেঁধে সহজ পাচ্য সাবলীল ভাষায় লেখার চেষ্টা করা প্রয়োজন ।
তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগ সব সময় রূপকথা শোনার চাহিদা রাখে। যেখানে কোন টেনশন থাকবে না সুখ ভরা মিষ্টি মিষ্টি গল্প। কিন্তু রূপকথা দিয়ে জীবন চলে না। ফেসবুকের কাল্পনিক জীবনে তারা বাস্তবটা হারাচ্ছে সাথে নষ্ট করছে নিজের চিন্তা শক্তি।। তাদের নিজের জীবনের সমস্যা আশা নিরাশা হতাশাগুলো ফোকাস করা কিন্তু ভালো লেখকদের দায়িত্ব। একটা গল্পের মাধ্যমে পাঠক যত বেশি নিজেকে আবিষ্কার করবে ততবেশি লেখক সফল। আমি কখনো পাঠক চাহিদা মতো গল্প লিখিনি। আমি নিজের চাহিদা মতো লিখেছি৷ কারণ গল্পটা আমাকে আগে উপভোগ করতে হবে আমি চেষ্টা করেছি জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোকে নিজের মতো করে সাজিয়ে লিখতে; নিজের যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতে। আমার গল্পের চরিত্র গুলো যেন খোদ পাঠকই হয় সেই চেষ্টা ছিল।পাঠক সেসবে যোগাযোগ স্থাপন করতে যদি পারে, ফেরিটেল থেকে কিছুটা রিয়েলিটি জানতে পারলেই আমি খুশি৷
লেখক কিন্তু যে কেউ হতেই পারে, কিন্তু সাহিত্যিক কজন হয় সেটা ভেবে দেখা দরকার | শারমিন আঞ্জুম
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার উপন্যাসগুলো তো সব বয়সীদের কাছেই ভীষণ জনপ্রিয়। তারা আপনার লেখায় আলাদা কী খুঁজে পায় বলে আপনার মনে হয়?
শারমিন আঞ্জুমঃ আমার আসলেই জানা নেই।একেক প্রজন্মের কাছে একেকটা বিষয় টানে হয়তো। যেমন একটা উদাহরণ দেই, নির্বাসন গল্পে নতুন প্রজন্ম প্রেমের অংশটা বেশি বেশি পড়ে তাদের কাছে গল্পের ক্লাইম্যাক্স রাজনৈতিক দাঁওপেচের অংশটা ততটা চোখে পড়ে না আবার অন্য প্রজন্ম এটাকেই বেশ পছন্দ করে একটু বয়স্করা পারিবারিক মূল্যবোধটা পছন্দ করেন।। আমার চেষ্টা থাকে একটা
বাস্তব ঘেষা গোটা একটা চলমান পৃথিবী তৈরি করা যা কম বেশি সবাইকে টানবে।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ লেখালেখির জগতে আপনার প্রাপ্তি বা অতৃপ্তি নিয়ে কিছু বলুন।
শারমিন আঞ্জুমঃ প্রাপ্তি তো অকল্পনীয়। ভাবতেই পারিনি আমার আবলতাবল ভাবে লেখা গল্পগুলো কখনো এতটা পাঠকপ্রিয়তা পাবে৷ চেনা অচেনা পাঠকের হাতে যাবে। দেশে বিদেশে কতজনের সেল্ফে আমার বই উঠবে এসব ভাবনার বাইরে ছিল। এই সবই দারুণ প্রাপ্তি বলা যায়৷ স্রষ্টার কাছে এর জন্য ধন্যবাদ দিতে আমার শব্দ কম পড়ে যায়৷
আমার লেখক জীবনের প্রাপ্তিগুলো অকল্পনীয় ছিল বলেই বাহ্যিক অতৃপ্তি গুলোকে তেমন পাত্তা আমি দেই না। বই লেখক হিসেবে বলা যায় কিছু অসাধু প্রকাশক নিয়ে আমার অভিযোগ আছে। অবশ্যই এদের হাতে লেখকরা সব সময় ঠকে৷ বই প্রকাশের পরে প্রচারণায় তাদের কোন আগ্রহ থাকে না সব দায় লেখকের ঘাড়ে ছেড়ে দেন। তবে সবাই নয় যেমন চলন্তিকা, উপকথা বইবাজার প্রকাশিনী আমার দৃষ্টিতে এই পর্যন্ত যত্নশীল পেশাদার আচরণ করেছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে অতৃপ্তি আছে বলেই লিখে যাচ্ছি। সব গল্প শেষ হলেই মনে হয় কিছু যেন রয়ে গেছে বলার। সেরা লেখাটা যেন এখনো পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারিনি।যা লিখলাম তা আরও সুন্দর কিছু হতে পারতো।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ এখনকার লেখকদের মধ্যে একটা নিরব প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
শারমিন আঞ্জুমঃ সৃজনশীলতা আসলে প্রথমে উপভোগের ব্যাপার। সবচেয়ে আগে সৃষ্টিটা নিজের উপভোগ করতে হবে৷ তবে ভালো বিষয়ে প্রতিযোগিতায় পৃথিবী সব সময় ভালো কিছুই পেয়েছে ৷ বড় বড় শিল্প সৃষ্টি হয়েছে দুজন মেধাবী শিল্পীর অন্তঃপ্রতিযোগিতায়৷ প্রতিযোগিতা যদি হয় নতুন কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে সেটা অবশ্যই ইতিবাচক ৷ এভাবে সাহিত্যেও অনেক ভালো কিছু আমরা পেয়েছি ৷ সাহিত্যিকদের মাঝে প্রতিযোগিতা হয়েছে আবার সেই সাথে একে অপরকে উৎসাহও দিয়েছেন। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ সমসাময়িক লেখক ছিলেন প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যেও ছিল। ফলবশত তারা একের পর এক অমর সৃষ্টি করে গেছেন এসবে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়নি? আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শীর্ষেন্দু সমসাময়িক লেখক পাল্লা দিয়ে লিখেছেন একের পর এক অনবদ্য সব লেখা। উনাদের প্রতিযোগিতা তো আমাদের জন্য উপরি পাওয়া। তবে জনপ্রিয়তা পাবার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে গেলেই ব্যাপারটায় ঝামেলা বেধে যায়৷ আজকালকার অনেক লেখক লেখা দিয়ে সেলিব্রিটি হবার চেষ্টায় থাকেন। এই ব্যাপারগুলো আমার পছন্দ কখনোই ছিল না। আমি এই খাতায় কখনো নামও লেখাতে চাই না।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
শারমিন আঞ্জুমঃ পাঠকদের বিনিতভাবে শুধু কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আমি ধন্য আপ্লুত এই ভালোবাসায়। নতুন গল্পের জন্য তাদের অপেক্ষা, বই দেরিতে আসায় তাদের অভিমান, আবদার সব শিরধার্য। এত কিছু এই জীবনে পাওনা ছিল সেটাই ছিল ধারণায় বাইরে। করুণাময়ের কাছে শুধু প্রার্থনা যেন আমি অল্প হলেও মানসম্মত লিখে যেতে পারি। যা আমার পাঠক একবার পড়ে ভুলে যাবেন না বারবার পড়তে চাইবেন।
সানজিদা হোসাইন মিমিঃ আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাদের দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। অনেক কিছু জানতে ও জানাতে পারলাম প্রিয় লেখক শারমিন আঞ্জুম সম্পর্কে। ভালো থাকবেন।
শারমিন আঞ্জুমঃ আপনাকেও অনেক ভালোবাসা আপু।
লেখক কিন্তু যে কেউ হতেই পারে, কিন্তু সাহিত্যিক কজন হয় সেটা ভেবে দেখা দরকার | শারমিন আঞ্জুম
Sanjida Hossain