মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৫
Google search engine
সব
    প্রচ্ছদজীবনধারাপ্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের | তামান্না জেনিফার

    প্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের | তামান্না জেনিফার

    প্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের | তামান্না জেনিফার৷
    প্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের –তামান্না জেনিফার৷

    প্রথমেই বলে নিই ROP কী ?

    – Retinopathy of prematurity যাকে সংক্ষেপে বলা হয় ROP. ROP হলো প্রিম্যাচিয়ুর শিশুদের অন্ধত্বের জন্য দায়ী এক ঘাতক ব্যাধি৷ এর পাঁচটা স্টেজ আর তিনটা জোন আছে৷ এক স্টেজ থেকে তার পরের স্টেজ ভয়াবহ৷ পঞ্চম স্টেজে সম্পূর্ণরূপে রেটিনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এটিই রোগের শেষ পর্যায়৷ এই পর্যায়ে শিশুর চোখ মারাত্মক দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে৷ এ এক এমন ভয়াবহ রোগ যার কোন লক্ষণ নাই৷ শুধুমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই এ রোগ সনাক্ত করা যায়৷ সর্বপ্রথম ১৯৪২ সালে এই রোগ সনাক্ত করা হয়৷

    এবার বলি, কাদের হয় এই রোগ?

    – এখানে আনন্দের কথা এটিই যে এই রোগটা সবার হয় না৷ শুধুমাত্র তিনটি ক্ষেত্রে এই রোগের সম্ভাবনা থেকে যায়৷

    ১. বত্রিশ সপ্তাহ বা তার আগে যদি কোন শিশু জন্মগ্রহন করে৷

    ২. জন্মের সময় যদি শিশুর ওজন দুই কেজির কম হয়৷

    ৩. যদি জন্মের পর শিশুর হাই ফ্লো অক্সিজেন লাগে৷

    সদ্য জন্মানো শিশুটির যদি এই তিনটির যেকোন একটি বা একাধিক সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে কী করতে হবে তা এবার জেনে নেই৷

    বত্রিশ সপ্তাহ বা তার আগে জন্মানো কম ওজনের শিশুদের অবশ্যই একজন রেটিনা স্পেশালিস্ট এর কাছে নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যেই ROP পরীক্ষা করাতে হবে৷ আর ২৮ সপ্তাহের আগে জন্মানো বাচ্চাদের ২০ দিনের মধ্যে ROP পরীক্ষা করাতে হবে৷ যেহেতু আগেই বলেছি, এ রোগের কোনও লক্ষণ নেই, তাই শুধুমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই এ রোগ সনাক্ত করা সম্ভব৷ যত দ্রুত সনাক্ত করা সম্ভব, তত সহজে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ এমন কী একদম শুরুর দিকে ধরা পড়লে কোন চিকিৎসা ছাড়াই শিশু সুস্থ হতে পারে৷ এ রোগ দিনে দিনে বাড়ে, প্রতিটি ঘণ্টা এখানে মূল্যবান৷ সময়মত ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ দৃষ্টি ফিরে পাওয়া সম্ভব৷

    আমি কোন চিকিৎসক নই৷ আমি একজন ভুক্তভোগী মা৷ আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় যতটুকু জেনেছি ততটুকুই বললাম৷ এবার আমার নিজের অভিজ্ঞতা বা ROP বনাম আমাদের যুদ্ধের গল্পটা বলি৷

    ২০১৮ সালের জানুয়ারীর এক তীব্র শীতের রাতে আমার ছোট ছেলে তাহীম জন্মায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই৷ যেখানে তার গর্ভে থাকার কথা ছিল ৪০ সপ্তাহ সেখানে সে গর্ভে ছিল মাত্র ৩১ সপ্তাহ৷ যখন একটি শিশু সময়ের আগে জন্মায় তখন তার সব অঙ্গ ঠিকভাবে পরিনত হয় না৷ এরকমই একটি অঙ্গ হলো চোখ, যা কিনা পরিপূর্ণ ভাবে তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ৩৬ সপ্তাহ৷

    প্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের | তামান্না জেনিফার৷
    তাহীমের জন্মের পর ডাক্তাররা ওকে আমাকে দেখাবার সময়টুকুও পাননি, ওকে নিয়ে ছুটেছেন NICU তে৷ সেখানে ওকে থাকতে হয়েছে ১৩ দিন৷ প্রথম দশ দিন ওর অনেক বেশি অক্সিজেনও লেগেছিল৷ জন্মের সময় বাবুর ওজন ছিল দেড় কেজি আর তেরো দিন পর যখন ওকে বাসায় আনি তখন ওর ওজন ১.৩ কেজি ৷

    আমরা তো ভীষণ খুশিতে ওকে বাড়ি নিয়ে আসলাম৷ দিনে দিনে ওর উন্নতিও হচ্ছিল৷ চুষে খাওয়া শিখে ফেলল, ওজন বাড়ছিল, শব্দ হলে এদিক ওদিক তাকাত৷ হাসি কান্না মিলিয়ে একদম একটা সুস্থ বাচ্চা৷ আমরা কোনোভাবেই বুঝিনি ওর মায়াভরা আদুরে চোখদুটো আক্রান্ত হয়েছে ROP নামক ঘাতক ব্যধিতে, যার জন্য ধীরে ধীরে ওর চোখের আলো নিভে যাচ্ছে৷ NICU থেকে ছাড়ার সময় ডিসচার্জ পেপারে লেখা ছিল যেন এক মাস পর যেন ROP (retinopathy of prematurity) টেস্ট করাই৷ তারা কোনও জোর দিয়ে বলেনি যে এক মাসের মধ্যেই করাতে হবে, আর আমরাও গুরুত্ব দিইনি৷ ভেবেছি, সবই তো ঠিক আছে৷ তারপরও বাবুর ঊনচল্লিশ দিন বয়সে আমরা রংপুরে ‘দ্বীপ আই কেয়ারে’ গেলাম টেস্টটি করাতে৷ আর সেখানেই জানতে পারলাম আমার বাচ্চাটা এই রোগের স্টেজ টু, জোন টুতে রয়েছে৷ খবরটি শোনার পর আমি প্রথমে বুঝিইনি বিষয়টী কী ! ডাক্তার আমাকে ডাকলেন৷ আমাকে তার সামনে বসিয়ে খুব শান্ত গলায় বুঝিয়ে বললেন, রোগটা কী এবং এর ভয়াবহতা কতখানি ! আমি ততক্ষনে জমে পাথর হয়ে গেছি৷ আমাকে উনি সাহস দিয়ে বললেন, বাবুর চোখ এখনও চিকিৎসা করে ভালো করা সম্ভব, তবে সময় নষ্ট করা যাবে না আর৷

    যেহেতু আমরা নয়দিন দেরি করে ফেলেছিলাম, তিনি পরামর্শ দিলেন আমরা যেন আজই ঢাকায় যাই৷ এ রোগের চিকিৎসা তখন রংপুরে ছিল না, এখন আছে কী না আমার জানা নেই৷ আমার চোখের অশ্রুবিন্দু যেন শুকিয়ে গিয়েছিল৷ মুহূর্তেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি ভেঙ্গে পড়লে সব ভেসে যাবে৷ আমাকে শক্ত থাকতেই হবে৷ আমি শক্ত হয়েই ডাক্তারের কাছে শুনে নিলাম ঢাকায় কোথায় যাব, খরচ কেমন হবে এসব৷ এরপর আমার স্বামীকে (সে তখন ঢাকাতেই ছিল) ফোন দিয়ে বললাম টাকা রেডি রাখতে, সে রাতেই ঢাকায় রওনা দিলাম৷

    পরদিন গেলাম বাংলাদেশ আই মেডিকেল হাসপাতালে৷ ওখানকার ডাঃ শফিকুর রহমান (যার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো) বাবুকে আবার পরীক্ষা করে দেখলেন, জানলাম সাইলেন্ট কিলারটা আর একটু বেড়ে গেছে একদিনেই৷ ঐদিনেই বাবুর চোখে ইনজেকশন দেওয়া হলো৷ উনি আমাদের আবার দুইদিন পর আসতে বললেন৷ দুইদিন পর আবার পরীক্ষা করে দেখবেন কী অবস্থা৷ প্রয়োজনে লেজার অপারেশন লাগতে পারে সেটিও বলে দিলেন৷

    বাবুর তেতাল্লিশ দিন বয়সে আবার গেলাম সেখানে৷ আবার পরীক্ষা করা হলো৷ পরীক্ষা করার পর ডাক্তার আমাদের তার চেম্বারে বসিয়ে খুব সুন্দর করে ছবি এঁকে এঁকে পুরো ব্যাপারটা বোঝালেন বাবুর এখন কী অবস্থা৷ মনে হচ্ছিল, আমরা যেন শিক্ষার্থী আর উনি এমন এক শিক্ষক যিনি কঠিন বিষয়ও সহজ করে পড়াচ্ছেন৷ তিনি জানালেন, লেজার লাগবে, যত দ্রুত সম্ভব৷ আমরা পরেরদিনই লেজারের জন্য তৈরি হলাম৷ বাবুকে যখন ডাক্তারের হাতে দেই মনে মনে শুধু বলেছিলাম “আল্লাহ, আমার সন্তানকে আমি তোমার হাতে সোপর্দ করলাম৷” পুরো এক ঘণ্টার লেজার সেশন শেষে ডাক্তার বের হয়ে বলেছিলেন “আপনাদের মত ধৈর্যশীল বাবা মা আর আপনার বাচ্চার মত ধৈর্যশীল বাচ্চা আমি আমার ক্যারিয়ারে আর একটিও পাইনি৷ আশি পারসেন্ট কাজ হয়ে গেছে খুব ভালোভাবে আলহামদুলিল্লাহ, আগামীদিন বাকীটা করবো৷” এরপর আরও পনেরো মিনিটের লেজার সেশন লেগেছে বাবুর৷ নিয়মিত ছয়মাস আমরা তার কাছে গেছি৷ ছয় মাস পর তিনি বললেন বাবুর আর সমস্যা নাই, তবে ও হাইলি মায়োপিক হতে পারে, হয়ত চশমা লাগবে সারাজীবন৷

    আমি শুনে মনে মনে বলেছিলাম চশমা দিয়ে হলেও আমার বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখুক৷

    ছয় মাসের পর থেকে উনি অন্য একজন ডাক্তারের কাছে রেফার করে দিলেন৷ আমি তার নাম বলবো না, তবে তার কাছে গিয়ে আমি শান্তি পেতাম না৷ উনি কথাই বলতেন না৷ দুইবার যাবার পর আর সেখানে যাইনি৷ আমার স্বামীর ব্যাচমেট ডাক্তার তারজিয়া আসমা জাফরুল্লাহর কাছে এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রত্যেক তিন মাসে একবার করে যাই৷ আট মাস বয়সে বাবুর চোখে চশমা তুলে দিতে হলো আমাকে, পাওয়ার ছিল -৬/-৮, এখন পাওয়ার -৫.৫/-৭.৫৷ তারজিয়া আপু অনেক যত্ন নিয়ে আমার বাচ্চাটাকে দেখেন, আল্লাহ তার ভালো করুক৷

    প্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের | তামান্না জেনিফার৷
    আমার ভুল ছিল একটাই৷ আমি নয়দিন দেরী করে ফেলেছিলাম৷ যার জন্য ভুগতে হয়েছে বাবুকে সাথে সাথে আমাদেরকেও৷ কিন্তু এই ভুলটা হতো না যদি আমাদের NICU থেকে ছাড়ার সময় বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বলা হত৷

    সময় মতো ধরা পরলে এই রোগের যথেষ্ট ভালো চিকিৎসা বাংলাদেশে আছে৷ তাই শুধু দরকার সচেতনতা৷ দরকার গাইনী ও শিশু ডাক্তারদের আরও একটু সহায়তা৷ আমি যেমন জানতাম না, অনেক মা ই ব্যাপারটা জানে না৷ সময় পেড়িয়ে গেলে আফসোস ছাড়া আর কিচ্ছু করার থাকে না৷ অথচ সঠিক সময়ে ধরা পরলে বাঁচতে পারে একটি শিশুর দৃষ্টি৷

    প্রিম্যাচিয়ুর বাচ্চা যাদের হয়েছে, তারা অবশ্যই এই টেস্টটা নিজ উদ্যোগেই করাবেন, ডাক্তার বলুক বা না বলুক৷ কারণ ঐ যে একটাই, “এ রোগের কোন লক্ষণ নাই৷” সময় পেরিয়ে যাবার আগেই সচেতনতা বাড়াই৷ আমি ভুক্তভোগী মা, আমি জানি এই জ্বালা। আমি ভুক্তভোগী বলেই জানানোর প্রয়োজন বোধ করলাম, যেন আপনাকেও ভুক্তভোগী না হতে হয়৷

    ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল শিশু৷ প্রয়োজনে খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন মিডিয়ার মাধ্যমে ডাক্তাররা জনগনকে এই রোগ সম্পর্কে জানাক৷ সচেতনতা আরও বাড়ুক৷ একজন ভুক্তভোগী মা হিসেবে আমার চাওয়া শুধু এটুকুই৷

    সবার জীবন সুন্দর হোক৷

    প্রতিপক্ষ ছিল ROP, যুদ্ধটা মা ও ছেলের | তামান্না জেনিফার৷

    একই ধরনের লেখা

    আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুনঃ

    আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
    এখানে আপনার নাম লিখুন

    - Advertisment -
    Google search engine

    সব থেকে বেশি পঠিত পোস্ট

    সাম্প্রতিক মন্তব্য